ভারতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ৬ জন নিহত

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী জেলায় গঙ্গনানি এলাকায় বৃহস্পতিবার সকালে একটি যাত্রীবাহী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও একজন। তারা সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র চারধাম যাত্রার অংশ হিসেবে গঙ্গোত্রী ধামে যাচ্ছিলেন।
হেলিকপ্টারটি দেরাদুনের সাহস্রধারা হেলিপ্যাড থেকে ছেড়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ মিটার গভীর খাদে পড়ে যায়। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে উত্তরাখণ্ড পুলিশ ও এসডিআরএফ (স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স)। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকারী দল, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও চিকিৎসা টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিযান শুরু করে।
নিহতদের পরিচয় ও যাত্রী তালিকা
হেলিকপ্টারে পাইলটসহ মোট সাতজন ছিলেন। নিহতদের মধ্যে পাঁচজন নারী ও একজন পুরুষ পাইলট। আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি বর্তমানে উত্তরাখণ্ডের এআইআইএমএস ঋষিকেশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নিহতদের পরিচয় নিচে দেওয়া হলো:
- কালা চন্দ্রকান্ত সোনি, ৬১ বছর, মুম্বাই
- বিজয়া রেড্ডি, ৫৭ বছর, মুম্বাই
- রুচি আগরওয়াল, ৫৬ বছর, মুম্বাই
- রাধা আগরওয়াল, ৭৯ বছর, উত্তরপ্রদেশ
- বেদাবতী কুমারী, ৪৮ বছর, অন্ধ্রপ্রদেশ
- ক্যাপ্টেন রবিন সিং, ৬০ বছর, পাইলট
আহত যাত্রীর নাম এম. ভাস্কর, ৫১ বছর বয়সী, তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা গুরুতর হলেও স্থিতিশীল।
দুর্ঘটনার প্রকৃতি ও উদ্ধার অভিযান
দুর্ঘটনার পরে এসডিআরএফ এর একাধিক দল গঙ্গনানি এলাকায় তৎপরতা চালায়। তাদের মধ্যে ভাটওয়ারি এবং উজেলি থেকে দুটি দল প্রাথমিকভাবে পাঠানো হয়। খাদ অনেক গভীর হওয়ায় উদ্ধারকাজে বেগ পেতে হয়। হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে এবং মৃতদেহগুলো খাদ থেকে বহন করে সড়কে তোলা হয়। আহত যাত্রীকেও দড়ি ও স্ট্রেচারের মাধ্যমে খাদ থেকে তুলতে হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হেলিকপ্টারটি ভেঙে পড়ার সময় বিকট শব্দ হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু
ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘এয়ারক্রাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (AAIB) ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। হেলিকপ্টারটির ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা খারাপ আবহাওয়া দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি এক টুইট বার্তায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, “এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আহত যাত্রীর সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
হেলি অ্যারোট্রান্স সার্ভিসেস: অতীত রেকর্ড
দুর্ঘটনাকবলিত হেলিকপ্টারটি পরিচালনা করছিল হেলি অ্যারোট্রান্স সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। সংস্থাটি চারধাম যাত্রায় নিয়মিত হেলিকপ্টার সেবা দিয়ে থাকে। ২০২২ সালেও উত্তরাখণ্ডে একটি চারধাম হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত হয়েছিলেন, তখনও হেলিকপ্টারটি একটি প্রাইভেট কোম্পানির পরিচালনায় ছিল। এই ধরনের দুর্ঘটনা চারধাম রুটের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
চারধাম যাত্রা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
চারধাম যাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থযাত্রা, যা গঙ্গোত্রী, ইয়ামুনোত্রী, কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ—এই চারটি ধাম নিয়ে গঠিত। প্রতিবছর লাখো মানুষ এই যাত্রায় অংশ নেন। যাত্রীদের সময় ও কষ্ট কমাতে অনেকেই হেলিকপ্টার সেবা ব্যবহার করে থাকেন। তবে বারবার দুর্ঘটনার কারণে হেলিকপ্টার চলাচল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
স্থানীয় পর্যটন ও বেসরকারি বিমান সংস্থা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চারধাম যাত্রায় ব্যবহৃত হেলিকপ্টারগুলোর অধিকাংশই পুরনো ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস অগ্রাহ্য করে ফ্লাইট পরিচালিত হয়। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়।
প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের দাবি
এই দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সাধারণ মানুষ হেলিকপ্টার চলাচলের নিরপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরো কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেলিকপ্টার চলাচলের জন্য সুনির্দিষ্ট আবহাওয়া সতর্কতা ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত যাচাই-বাছাই, পাইলটদের প্রশিক্ষণ ও যাত্রীসুরক্ষা প্রোটোকল প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে চারধাম যাত্রা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সারসংক্ষেপে মূল তথ্য:
- দুর্ঘটনার স্থান: গঙ্গনানি, উত্তরকাশী, উত্তরাখণ্ড
- সময়: ৮ মে ২০২৫, সকাল ৮:৪৫
- হেলিকপ্টার কোম্পানি: হেলি অ্যারোট্রান্স সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড
- গন্তব্য: গঙ্গোত্রী ধাম
- যাত্রী সংখ্যা: ৭ জন (৬ যাত্রী, ১ পাইলট)
- মৃত্যু: ৬ জন
- আহত: ১ জন
- উদ্ধার অভিযান: এসডিআরএফ, পুলিশ, চিকিৎসা দল
- তদন্ত: AAIB (এয়ারক্রাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো)