গাজায় চরম খাদ্য সংকটে বাড়ছে লুটপাট ও অপরাধ, ভেঙে পড়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা

গাজায় ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে স্থানীয়রা চরম ক্ষুধা, অভাব ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। খাবার, ওষুধ, জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য এক প্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনিরা। এই সংকট পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে কিছু সশস্ত্র অপরাধী গোষ্ঠী। খাদ্য, পানি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য মানবিক সহায়তা কেন্দ্রগুলোর ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে লুটপাট, চুরি ও সহিংসতা।
আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ভেঙে পড়েছে
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের বরাতে জানা গেছে, গাজায় ইসরায়েলের টানা অবরোধের কারণে জনজীবন কার্যত থমকে গেছে। গাজার বিভিন্ন এলাকায় এখন পুলিশের কোনো কার্যকর উপস্থিতি নেই। ফলে খাদ্য সহায়তার গুদাম, এনজিও অফিস, কমিউনিটি কিচেনসহ সব স্থানে বেড়েছে সশস্ত্র হামলা ও লুটপাট।
সহায়তা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ২০ লাখেরও বেশি মানুষ এখন চরম খাদ্য সংকটে ভুগছে। তাদের অনেকেই দিনে এক বেলার বেশি খাবার পাচ্ছে না। ফলে ক্ষুধার তাড়নায় বহু মানুষ চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, ময়লা ও পচা ময়দা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বাজার মূল্যের ৩০-৪০ গুণ বেশি দামে। কাঠ বা প্লাস্টিক পোড়ানো ছাড়া অন্য কোনো জ্বালানি নেই।
খাদ্যের জন্য সংঘর্ষ, সহিংসতায় প্রাণহানি
গাজা শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে উঠে এসেছে। সম্প্রতি সেখানে কিছু সশস্ত্র দল একাধিক বেকারি ও এনজিও পরিচালিত কিচেন সেন্টারে হামলা চালিয়ে খাবার ও রান্নার পাত্র লুটে নেয়। এক ঘটনায় দেখা গেছে, ছুরির মুখে একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কর্মীদের জিম্মি করে খাদ্য মজুত লুটে নেওয়া হয়।
ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ তাদের গাজা সিটি ফিল্ড অফিসে ঢুকে জোর করে ওষুধ নিয়ে গেছে। এর ফলে সংস্থাটিকে সেখানে কার্যক্রম বন্ধ করে কর্মীদের সরিয়ে নিতে হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব লুটপাটের সময় প্রায়শই চোরদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের গোলাগুলি হয়। গাজার বাসিন্দা আইনজীবী আনাস রাফাত জানান, এক রাতে তাদের পাশের একটি এনজিও গুদামে সশস্ত্র হামলার সময় পুরো পরিবার গুলির মধ্যে মেঝেতে শুয়ে ছিলেন দুই ঘণ্টারও বেশি।
আরেক বাসিন্দা গাদির রজব জানান, খাবার ও পানির জন্য মানুষ যখন একটি গুদামে হামলা চালাচ্ছিল, তখন পাশের জানালা দিয়ে এক মা চিৎকার করছিলেন তাঁর ছেলের খোঁজে—যার কাঁধে গুলি লেগেছিল।
বাড়ছে ঘরোয়া সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা
শুধু বড় ধরনের লুটপাটই নয়, গাজায় এখন ছোটখাটো চুরি, পারিবারিক সহিংসতা ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সংঘর্ষও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গাজার উত্তর শহর বাইত লাহিয়া থেকে পালিয়ে আসা মারি আল রাদেয়া জানান, তিনি ও তাঁর ৯ সন্তান একটি তাঁবুতে বাস করছেন। তাঁরা পালা করে ঘুমান, কারণ রাতে চুরি ও হামলার ভয় সব সময় কাজ করে।
রাদেয়া জানান, তাঁর আশেপাশের প্রায় সব তাঁবুতেই চুরি হয়েছে, কিন্তু কে চোর তা জানার চেষ্টাও কেউ করছে না, কারণ পুলিশের উপস্থিতি নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা যেখানে নাইলনের তাঁবুতে থাকি, সেখানে প্রায়শই গুলি এসে পড়ে। কোনো নিরাপত্তা নেই।’
হামাসের নিয়ন্ত্রণেও ভাঙন
গাজায় কয়েক মাস আগেও হামাস তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলি বিমান হামলায় পুলিশকে লক্ষ্যবস্তু করার পর সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। হামাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সম্প্রতি লুটপাটে জড়িত ছয় সন্দেহভাজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে পায়ে গুলি করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গাজা সিটির প্রধান কয়েকটি রাস্তায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।
সাহায্য সংস্থাগুলোর হুঁশিয়ারি
গাজার প্রধান ত্রাণ সহায়তা কেন্দ্রগুলো প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ১০ লাখ মানুষকে খাদ্য সরবরাহকারী কমিউনিটি কিচেনগুলো এখন আর কার্যকরভাবে চালানো যাচ্ছে না। একাধিক বেকারি গত মাসে বন্ধ হয়ে গেছে।
সহায়তাকারী সংস্থাগুলো বলছে, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করলেও তা অনেক দেরিতে হবে। তারা বলছে, বাস্তবতাই এখন চরম সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইসরায়েলি পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্ক
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ‘ব্যাপক’ সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে কিছু মানবিক সহায়তার বিতরণ কেন্দ্র গঠনের পরিকল্পনা করেছে। এগুলো পরিচালনা করবে বেসরকারি ঠিকাদার এবং নিরাপত্তা দেবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এই পরিকল্পনাকে অকার্যকর ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ‘সম্ভাব্য অবৈধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
সাহায্যের গাড়িবহরে লুটপাট
গত বছরের শেষ দিকে ইসরায়েলি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশকালে সহায়তার শতাধিক ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। গাজায় খাদ্য পৌঁছানোর আগেই এসব সহায়তা গায়েব হয়ে যায়। ইসরায়েলের অভিযোগ, হামাস এই সহায়তা চুরি করে কালোবাজারে বিক্রি করছে—যদিও হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধুই মানবিক সংকট নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও নিরাপত্তা সংকটে রূপ নিয়েছে। ক্ষুধা, অনিশ্চয়তা ও দমবন্ধ পরিবেশে মানুষ অপরাধের পথে ঠেলে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার পাশাপাশি স্থায়ী সমাধানের জন্য এখন জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন।