পাকিস্তানে ভারতের অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ কেন

দীর্ঘদিন ধরেই উপমহাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত। এবার সেই উত্তেজনা পরিণত হয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘাতে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তানের অন্তত ছয়টি স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’—যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে কূটনৈতিক মহলেও ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠেছে—একটি সামরিক অভিযানের নাম কেন দেওয়া হলো ‘সিঁদুর’, যা মূলত হিন্দু বিবাহিত নারীদের একটি প্রতীক?
‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের তাৎপর্য
‘সিঁদুর’ শব্দটি হিন্দুধর্মে বিবাহিত নারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতীক। নারীরা তাদের স্বামীর জীবিত থাকার প্রতীক হিসেবে সিঁথিতে সিঁদুর পরেন। এই সংস্কৃতির প্রতীককেই কেন একটি প্রাণঘাতী সামরিক অভিযানের নামে ব্যবহার করা হলো, সেটি নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা সূত্রের দাবি, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর চালানো বন্দুকধারীদের হামলায় যেসব ব্যক্তি নিহত হন, তাদের বেশির ভাগই হিন্দু এবং অনেকেই নববিবাহিত ছিলেন। তাদের মধ্যে বহু নারী স্বামী হারিয়ে সদ্য বিধবা হন। তাই, সেই ‘সিঁদুর মুছে যাওয়া’ নারীদের প্রতীকী প্রতিশোধ হিসেবেই এই অভিযানের নাম রাখা হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’।
পাকিস্তানে হামলা: কী ঘটেছে?
ভারতীয় সামরিক বাহিনী মঙ্গলবার রাত ১২টার পর পাকিস্তানের অন্তত ছয়টি স্থানে হামলা চালায়। এই অভিযান ছিল একযোগে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (ISPR) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর মতে:
- হামলায় নিহত: ২৬ জন
- আহত: ৪৬ জন
- ধ্বংস হয়েছে: সামরিক স্থাপনা ও আবাসিক ভবন
ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাবর্ষণে জম্মু ও কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ৭ জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩৫ জন।
বিমান যুদ্ধের পাল্টা দাবি
পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতীয় এই অভিযানের সময় তারা পাল্টা আক্রমণে ৫টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এই বিমানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ৩টি রাফাল (ফ্রান্সের তৈরি)
- ১টি সু-৩০ (রাশিয়ান)
- ১টি মিগ-২৯ (সোভিয়েত আমলের)
যদিও ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দাবি স্বীকার করেনি। তবে রয়টার্সকে দেওয়া স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩টি ভূপাতিত যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। তিনজন পাইলটকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পাঞ্জাবে জরুরি অবস্থা ও কাশ্মীরে ছুটি ঘোষণা
ভারতের হামলার পর পাকিস্তান তার জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে:
- সব স্কুল-কলেজ
- বিশ্ববিদ্যালয়
- অপ্রয়োজনীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
অন্যদিকে, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জম্মু, সাম্বা, কাঠুয়া, রাজৌরি ও পুঞ্চ জেলায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
হাসপাতালসহ জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতায়।
সামরিক উত্তেজনার সূচনাবিন্দু: পেহেলগাম হামলা
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনার সূত্রপাত ২২ এপ্রিলের পেহেলগাম হামলা থেকে। ওই দিন সন্ধ্যায় ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পর্যটন অঞ্চল পেহেলগামে সশস্ত্র বন্দুকধারীরা হামলা চালায়, যাতে ২৬ জন নিহত হন। এই হামলার পেছনে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাত রয়েছে বলে ভারত দাবি করেছে।
ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, হামলাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এতে পাকিস্তান সরকার অথবা সামরিক বাহিনীর অনুমোদন থাকতে পারে।
বিশ্লেষকদের চোখে ‘অপারেশন সিঁদুর’
নামকরণ নিয়ে বিশ্লেষকদের বক্তব্য দ্বিধাবিভক্ত। অনেকের মতে, এটি ভারতীয় রাজনৈতিক সরকারের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক বার্তা বহন করে, যা জাতীয়তাবাদী আবেগকে উত্তপ্ত করতে পারে।
ভারতের অভ্যন্তরে অনেক হিন্দু নারীর জন্য ‘সিঁদুর’ আবেগের একটি প্রতীক হলেও, একটি প্রাণঘাতী সামরিক অভিযানের সঙ্গে এ শব্দের ব্যবহার কেবল আঞ্চলিক উত্তেজনা নয়, ধর্মীয় সংকেত হিসেবেও গ্রহণ করা হতে পারে—বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে।
পাকিস্তানি বিশ্লেষকরা এটিকে একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতীক হিসেবেও অভিহিত করছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখনো ধীরগতি
এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন—কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থাই বা রাষ্ট্র এই অভিযানের বিষয়ে প্রতিবাদ বা উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। তবে কূটনৈতিক সূত্রে ইঙ্গিত মিলছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে তেল ও স্বর্ণের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
সম্ভাব্য পরিণতি: নতুন করে কাশ্মীরে সংঘর্ষ?
কাশ্মীর অঞ্চলেই এই সামরিক উত্তেজনা আবারও নতুন করে গেরো বাঁধতে যাচ্ছে। এর ফলে:
- কাশ্মীরে সেনা মোতায়েন বৃদ্ধি পাবে
- জঙ্গি তৎপরতা আরও বেড়ে যেতে পারে
- দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছাবে
- অর্থনৈতিক, মানবিক ও পরিবেশগত সংকট দেখা দিতে পারে