সুদানের প্রধান বন্দর পোর্ট সুদানে রক্তক্ষয়ী হামলা

সুদানের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর পোর্ট সুদানে টানা তৃতীয় দিনের মতো বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশটির নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় এবার গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর শহরটি সরাসরি হামলার শিকার হলো।
মঙ্গলবার (৬ মে) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, শহরটির আকাশে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং বন্দর এলাকার আশেপাশে ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামরিক এবং বেসামরিক স্থাপনাগুলোর পাশাপাশি জ্বালানি বা পণ্যগুদামে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
যুদ্ধের আগুন ছড়াল পোর্ট সুদানে
সুদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে পোর্ট সুদান এতদিন তুলনামূলকভাবে সংঘাতমুক্ত ছিল। রাজধানী খার্তুম এবং দারফুর অঞ্চলের শহরগুলো যখন RSF নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তখন সেনাবাহিনী তাদের কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে পোর্ট সুদানকেই ব্যবহার করে আসছিল। পাশাপাশি লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ এই শহরটিকে আশ্রয়ের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল। এবার সেই শহরেই সরাসরি আগুন ছড়িয়েছে গৃহযুদ্ধ।
কৌশল বদলে ড্রোন হামলার দিকে ঝুঁকছে RSF
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে RSF সরাসরি ভূমি যুদ্ধ থেকে সরে এসে ড্রোন ও দূরপাল্লার অস্ত্র হামলার দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে রাজধানী খার্তুমে নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর তারা পোর্ট সুদানসহ সেনা-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ড্রোন হামলা জোরদার করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি তাদের নতুন কৌশলের অংশ—সেনাবাহিনীর রসদ ও কৌশলগত অবস্থান দুর্বল করার পরিকল্পনা।
সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও বন্দর হুমকির মুখে
পোর্ট সুদানে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিটি সেনাবাহিনীর সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখান থেকেই খার্তুম ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ এলাকাগুলোর জন্য অস্ত্র, খাদ্য ও ওষুধ পাঠানো হয়। এছাড়া, এটি দেশটির বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবেও পরিচিত। এখন এই বন্দরেই হামলা হওয়ায় সুদানের অর্থনীতি, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং সামরিক সক্ষমতা বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংঘাতের শিকারে সাধারণ মানুষ
পোর্ট সুদানে এখনো বহু বাস্তুচ্যুত নারী, শিশু ও বৃদ্ধ আশ্রয় নিয়েছেন। শহরে চরম খাদ্য ও ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলার সময় বহু মানুষ প্রাণ বাঁচাতে শহরের বাইরের দিকে পালাতে শুরু করেছেন। অনেকে আবার বন্দর সংলগ্ন ইউনাইটেড নেশনস বা আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছেন।
RSF কী এবং কেন সংঘাত?
র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF) মূলত সুদানের প্রাক্তন স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরের সময় প্রতিষ্ঠিত একটি আধা-সামরিক বাহিনী। এর উৎপত্তি দারফুর অঞ্চলের জানজাওয়িদ মিলিশিয়া থেকে। ২০১৩ সাল থেকে তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষমতা কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে RSF ও সেনাবাহিনীর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যা এখনও চলছে। এখন পর্যন্ত সংঘাতে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও সহায়তা আহ্বান
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আফ্রিকান ইউনিয়ন ইতোমধ্যে পোর্ট সুদানে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে।
জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয় সংস্থা (OCHA) জানিয়েছে, বর্তমানে সুদানে ২ কোটি ৫ লাখের বেশি মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সংঘাত যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই এই সংখ্যাও বাড়ছে।
ভবিষ্যৎ কী?
বিশ্লেষকদের মতে, পোর্ট সুদানের মতো কৌশলগত শহরে হামলা সেনাবাহিনীর ওপর চাপ বাড়াবে এবং RSF-এর কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হতে পারে। তবে এতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা আরও গভীর হবে বলেই আশঙ্কা।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ড. সারাহ হান্টার বলেন, “পোর্ট সুদানে হামলা মানে শুধু একটি সামরিক ঘাঁটি নয়, এটি একটি মানবিক সংকটকেও বিপজ্জনকভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে।”