বিশ্ব

‘পূর্ণশক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া হবে’ পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ারি

ভারতের যেকোনো আগ্রাসন বা সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা বা জাতীয় মর্যাদার ওপর কোনো আঘাত এলে দেশটি পূর্ণ সামরিক শক্তি দিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানাবে। এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এলো, যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে।

কাশ্মীরে হামলার পর উত্তেজনা

গত ২২ এপ্রিল ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগাঁও এলাকায় একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই ঘটনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল, সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সীমিত করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ভারতের জন্য স্থল ও আকাশসীমা বন্ধ করেছে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সংকুচিত করেছে।

পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দাবি, তাদের কাছে ‘বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য’ রয়েছে যে ভারত আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। এই আশঙ্কা দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করেছে।

জেনারেল মুনিরের বক্তব্য

সোমবার (৫ মে ২০২৫) রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠিত ১৫তম ন্যাশনাল ওয়ার্কশপ বেলুচিস্তানে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে জেনারেল মুনির বলেন, “পাকিস্তান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তির পক্ষে। কিন্তু আমাদের সার্বভৌমত্ব বা জনগণের মর্যাদার ওপর কোনো আঘাত সহ্য করা হবে না। যেকোনো আগ্রাসনের জবাব আমরা পূর্ণ শক্তি দিয়ে দেব।” তিনি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চ মনোবল ও প্রস্তুতির প্রশংসা করে বলেন, “আমাদের সেনাবাহিনী যেকোনো হুমকির মোকাবিলায় সম্পূর্ণ সক্ষম।”

জেনারেল মুনির এ সময় বেলুচিস্তানের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ওপর সরকারের বিশেষ গুরুত্ব আরোপের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বেলুচিস্তানে সরকারের একাধিক প্রকল্প ইতোমধ্যে ফল দিতে শুরু করেছে। এই প্রদেশের উন্নয়ন আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে।” তবে তিনি বেলুচিস্তানে বিদেশ-প্ররোচিত সন্ত্রাসবাদকে ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যারা বেলুচ পরিচয়ের নামে বিভ্রান্তিকর ও হিংসাত্মক এজেন্ডা চালাচ্ছে, তারা এই প্রদেশের মর্যাদার প্রতি অপমান। তাদের ষড়যন্ত্র কখনো সফল হবে না।”

সামরিক মহড়া ও প্রস্তুতি

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সম্প্রতি একাধিক সামরিক মহড়ার মাধ্যমে তাদের প্রস্তুতি জোরদার করেছে। গত ১ মে পাঞ্জাবের ঝিলামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মংলা স্ট্রাইক কর্পস ‘হ্যামার স্ট্রাইক মহড়া’ চালিয়েছে। এই মহড়ায় ভারি অস্ত্র ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হয়। জেনারেল মুনির নিজে এই মহড়া পরিদর্শন করেন এবং সেনাদের মনোবল ও প্রস্তুতির প্রশংসা করেন। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডন’ জানিয়েছে, এই মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল শত্রুপক্ষের যেকোনো আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা।

এছাড়া, গত ২৯-৩০ এপ্রিল নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে কায়ানি ও মন্ডল সেক্টরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লাইভ ফায়ারিং মহড়া চালায়। এই মহড়ায় আসল গোলাবারুদ ও ভারি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা যুদ্ধের পরিস্থিতি অনুকরণ করে পরিচালিত হয়। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ জানিয়েছে, এই মহড়ার লক্ষ্য ছিল সেনাদের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি যাচাই করা।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পহেলগাঁও হামলার পর বলেছেন, “এই হামলায় প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের রক্ত ফুটছে। দোষীদের কঠিনতম শাস্তি দেওয়া হবে।” তিনি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, যাতে তারা যেকোনো সময় ও যেকোনো উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। ভারতের এই অবস্থান পাকিস্তানের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভারত ইতোমধ্যে সীমান্তে বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) এর উপস্থিতি বাড়িয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করেছে। এছাড়া, ভারত সম্প্রতি ২৬টি নতুন যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যা পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের আরেকটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাকিস্তানের অবস্থান

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, “পাকিস্তান কখনো প্রথমে যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু ভারত যদি উত্তেজনা বাড়ায়, তাহলে আমরা কঠোর জবাব দেব।” তিনি পহেলগাঁও হামলার নিন্দা করে বলেন, “পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আমরা নিরীহ মানুষের হত্যাকে কখনো সমর্থন করি না।” তিনি দাবি করেন, ভারত এই হামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে এবং আঞ্চলিক শান্তি বিঘ্নিত করছে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “সিন্ধু নদের পানিপ্রবাহ বন্ধ করা এক ধরনের আগ্রাসন। এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে পাকিস্তান সামরিকভাবে জবাব দেবে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব নেতারা উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার আহ্বান জানালেও ভারত এই বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button