৩০টি যুদ্ধবিমান নিয়ে ইয়েমেনে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলা

ইয়েমেনের হুতি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ইসরায়েলের ৩০টি যুদ্ধবিমান নিয়ে চালানো ভয়াবহ হামলা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই হামলা ইসরায়েলের প্রধান বিমানবন্দর বেন গুরিয়নে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একদিন পর সোমবার (৫ মে) সংঘটিত হয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল সেনাবাহিনী এই হামলার বিষয়টি এক্স পোস্টে নিশ্চিত করেছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইয়েমেনের হোদেইদা বন্দর এলাকায় ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ এবং হোদেইদার পূর্বে অবস্থিত একটি কংক্রিট কারখানায় এই হামলা চালানো হয়েছে। তেল আবিবের দাবি, ওই কারখানাটি হুতিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘অর্থনৈতিক সম্পদ’ এবং এটি ‘সুরঙ্গ ও সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে’ ব্যবহৃত হচ্ছিল।
ইসরায়েলের বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়েছে, ইরানের নির্দেশনা ও অর্থায়নে হুতিরা ইসরায়েল ও তার মিত্রদের ক্ষতি করে আসছে। এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল হুতিদের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করার লক্ষ্যে কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে।
হামলার পটভূমি
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা গত কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হামলা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি, ৪ মে ২০২৫ তারিখে হুতিরা ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যাতে ছয়জন আহত হয় এবং বিমান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। হুতিরা এই হামলাকে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে। এক্স পোস্টে হুতি নেতা হেজাম আল-আসাদ জানিয়েছেন, “গাজায় আমাদের লোকদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের আক্রমণ অব্যাহত থাকবে।”
ইসরায়েলের এই হামলা এমন এক সময়ে সংঘটিত হলো, যখন গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। গাজায় এখন পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এই সংঘাতের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে।
হামলার লক্ষ্য ও ক্ষয়ক্ষতি
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, হোদেইদা বন্দর এলাকায় হুতিদের সামরিক অবকাঠামো এবং কংক্রিট কারখানায় নিখুঁতভাবে আঘাত হানা হয়েছে। এই অবকাঠামোগুলো হুতিদের সামরিক পদক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। তবে, হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের কোনো তথ্য ইসরায়েলের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি।
অন্যদিকে, হুতিদের নিয়ন্ত্রণাধীন আল-মাসিরাহ টেলিভিশন জানিয়েছে, হোদেইদা বন্দরে চারটি এবং রাস ঈসা তেল স্থাপনায় দুটি হামলা চালানো হয়েছে। হুতিদের দাবি, এই হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আঘাত হানা হয়েছে এবং হতাহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। তবে, এই দাবির স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ইয়েমেনের বার্তা সংস্থা সাবা জানিয়েছে, হামলায় সানার দক্ষিণ ও উত্তরে দুটি কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই হামলার ফলে ইয়েমেনের ইতিমধ্যে সংকটাপন্ন বিপর্যস্ত অবকাঠামো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “ইসরায়েলকে অবশ্যই এ ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে এবং ইয়েমেনে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে।”
ইরান, যারা হুতিদের সমর্থন করে বলে অভিযোগ রয়েছে, এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইসরায়েলের এই আগ্রাসন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে আরও বিপন্ন করবে।”
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। তবে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিপূর্বে হুতিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছে, যা তারা “অপারেশন রাফ রাইডার” নামে অভিহিত করেছে।
হুতিদের প্রতিক্রিয়া
হুতিরা ইসরায়েলের এই হামলার জবাবে পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে। হুতি মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের জবাব দেওয়া হবে। আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাবো এবং গাজার যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের হামলা অব্যাহত থাকবে।”
হুতিরা ইতিপূর্বে ইসরায়েলের তেল আবিব, বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর এবং লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি, এই হামলাগুলো ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের অংশ।
ইয়েমেনের মানবিক সংকট
ইয়েমেন ইতিমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইয়েমেনের ৮০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ইসরায়েলের এই হামcards://cards/2024-12-24/ইসরায়েলে-ক্ষেপণাস্ত্র-হামলার-পর-ইয়েমেনের-বিভিন্ন-অংশে-হামলা-ইসরায়েলের/1653।jpgরা এই সংকটকে আরও গভীর করতে পারে, বিশেষ করে হোদেইদা বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে ত্রাণ সরবরাহ ব্যাহত হবে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, ইয়েমেনে ১৯ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। এই হামলার ফলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ইসরায়েল ও হুতিদের মধ্যে এই সাম্প্রতিক সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে। ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুতিরা এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘাত কেবল ইয়েমেন ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ইরান, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে এতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গাজার যুদ্ধ এবং ইয়েমেনের সংঘাতের মধ্যে সংযোগ বিবেচনায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই সংকট সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার সময় এসেছে।
ইসরায়েলের এই হামলা এবং হুতিদের পাল্টা হুমকি মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। আগামী দিনগুলোতে এই সংঘাত কোন দিকে যায়, তা এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।