বিশ্ব

পুরো গাজা দখলের অনুমোদন দিল ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা 

ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা দখল এবং সেখানে সামরিক অভিযানের পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছে। সোমবার (৫ মে ২০২৫) ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এই সিদ্ধান্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সর্বসম্মত সমর্থনে গৃহীত হয়েছে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

নতুন এই পরিকল্পনার আওতায় গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণভাবে দখল, দখলকৃত এলাকাগুলো ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং গাজার বাসিন্দাদের উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তরের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া, গাজায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য একটি নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়েও মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়েছে। তবে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়সীমা এখনও নির্ধারিত হয়নি। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগে এই পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম।

পরিকল্পনার বিস্তারিত

ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানা গেছে, নতুন পরিকল্পনাটি গাজা উপত্যকার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • সম্পূর্ণ দখল: গাজা উপত্যকার সকল এলাকা ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা।
  • নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা: দখলকৃত এলাকাগুলোতে স্থায়ীভাবে ইসরায়েলি উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
  • জনসংখ্যা স্থানান্তর: গাজার বাসিন্দাদের উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া, যা সম্ভবত রাফাহ এলাকার কাছাকাছি।
  • ত্রাণ ব্যবস্থাপনা: গাজায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য নতুন কাঠামোর মাধ্যমে সহায়তা প্রদান, যদিও এর বিস্তারিত এখনও স্পষ্ট নয়।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইসরায়েল হাজার হাজার সংরক্ষিত সেনাকে তলব করেছে। এই পদক্ষেপ গাজায় সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

গাজায় চলমান সংঘাত

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় তার সামরিক অভিযান শুরু করে, যা হামাসের সঙ্গে সংঘাতের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ব্যাপক হামলা শুরু করে। এই হামলায় এখন পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৫২,৫০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই নারী, শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তি।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় চলমান অবরোধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, গত ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ, ওষুধ এবং জ্বালানিসহ কোনো পণ্য প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে গাজার খাদ্য মজুদ শেষ হয়ে গেছে, এবং বাসিন্দারা চরম মানবিক সংকটের মুখোমুখি।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজায় মানবিক সংকট মোকাবিলায় ত্রাণ সরবরাহের ওপর জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। একটি বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার গাজায় চলমান সংঘাতের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফর এই সংকটের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ এই সফরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন এই পরিকল্পনার প্রতি কী অবস্থান নেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি

গাজায় চলমান সংঘাত এবং অবরোধের কারণে সেখানকার বাসিন্দারা চরম মানবিক সংকটের মুখোমুখি। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার (২ মে) ভোর থেকে ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় কমপক্ষে ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। এই হামলায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে শহীদ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী, শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তি। এছাড়া, ৫,০৭০টি পরিবার এখন কোনো রকমে টিকে আছে, কারণ এসব পরিবারে মাত্র একজন সদস্য অবশিষ্ট রয়েছে। এই পরিস্থিতি গাজার মানবিক সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরছে।

ভবিষ্যৎ প্রভাব

ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে গাজার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। গাজার বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তরের ফলে সেখানে জনসংখ্যার চাপ বাড়বে, এবং মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হবে। এছাড়া, ইসরায়েলের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি হামাসের সঙ্গে সংঘাতকে আরও উসকে দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এই পরিকল্পনার বিরোধিতা এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান অব্যাহত থাকলেও, ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গতিপথকে নতুন দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button