বিশ্ব

পাকিস্তান সরকার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেও সাধারণ মানুষের চাওয়া শান্তি

ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার আবহে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছে পাকিস্তান সরকার। সীমান্তে সাঁজোয়া যান ও যুদ্ধবিমান সক্রিয়, রাজনীতিকরা দিচ্ছেন কঠোর প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি। টেলিভিশনের পর্দায় একের পর এক উসকানিমূলক বার্তা প্রচারিত হচ্ছে, যেগুলো যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরও জিইয়ে রাখছে।

তবে পাকিস্তানের ভেতরে সাধারণ মানুষের মনোভাব এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানি নাগরিকদের কাছে যুদ্ধ এখন ‘অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা’। শান্তিই তাঁদের কাম্য।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব— যুদ্ধ নয়, মানুষের ভাবনার কেন্দ্রে এসব

বর্তমানে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যুদ্ধ নয়, বরং মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং জীবিকার নিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইসলামাবাদে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাহসিন জাহরা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “নেতারা শুধু শক্তি দেখাতে চান। আমাদের এত সমস্যা রয়েছে, সেখানে যুদ্ধের কথা তোলা বাড়াবাড়ি।”

তাঁর মতে, গত কয়েক বছরে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, যার চাপ তাঁর পরিবারের জীবনধারাকে কষ্টকর করে তুলেছে।

একই ধরণের মত দিয়েছেন ইসলামাবাদের ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইনামুল্লাহ। তিনি বলেন, “দেশ এখন দুর্বল অবস্থায় আছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক পতনের কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধ নিয়ে ব্যঙ্গ–বিদ্রুপ

যুদ্ধের ভয়ের মধ্যেও পাকিস্তানিরা আশ্চর্য রকম সহনশীল। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে যুদ্ধ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মিম তৈরি করছেন, যেগুলো ভারতীয় যুদ্ধাবেগকে উপহাস করছে। এসব হাস্যরস সাধারণ মানুষকে মানসিক চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।

লাহোরের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাভেরিয়া শাহজাদ বলেন, “এই সহনশীলতা যেমন মানসিক চাপ প্রশমনে কার্যকর, তেমনি এটি বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার একটি কৌশলও বটে।”

তিনি আরও বলেন, “গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও অর্থনৈতিক পতনের কারণে মানুষের ভেতরে এক গভীর হতাশা তৈরি হয়েছে।”

সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন প্রভাব ও জাতীয় ঐক্যের মিথ

পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনাবাহিনী শুধু সীমান্ত নয়, রাজনীতিতেও প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে। পূর্বেও, যেমন ২০১৯ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা জনসমর্থন পেয়েছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ঐক্যবদ্ধ চেতনার ঘাটতি স্পষ্ট।

রাজনৈতিক বিভাজন, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ এবং বিদ্রোহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আফগান সীমান্তে পাকিস্তান চলতি সপ্তাহেই ৫৪ সন্ত্রাসী হত্যার দাবি করেছে, আর বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলা আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।

পর্যটন, জীবিকা ও সীমান্তবাসীর আতঙ্ক

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পর্যটন নির্ভর অঞ্চলগুলোতে সীমান্ত উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে। নীলম উপত্যকার কেরান শহর, যেটি একসময় জমজমাট পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, এখন জনশূন্য। স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজা আমজাদ বলেন, “কেউ আর ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই পর্যটকেরা আসছেন না।”

অন্যদিকে, সীমান্তবর্তী আথমাকাম শহরের বাসিন্দা সাদিয়া বিবি গুলিবর্ষণের আশঙ্কায় তাঁর বাড়ির পেছনে থাকা বাংকার পরিষ্কার করছেন। “যেকোনো সময় গুলির লড়াই শুরু হতে পারে, আমি আমার সন্তানদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি,”—বলেছেন তিনি।

হতাশ পাকিস্তানিরা দেশ ছাড়ার স্বপ্ন দেখছেন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক পাকিস্তানিই দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন। ইসলামাবাদে করপোরেট খাতে কর্মরত ৩১ বছর বয়সী জারা খান বলেন, “পাকিস্তানে এখন স্বাধীনভাবে বাঁচা কঠিন হয়ে পড়েছে। চাকরির বাজারে সংকট, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ নেই।” তিনি আরও যোগ করেন, “এখানে জীবনযাপন খুব হতাশাজনক।”

যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন শান্তি ও সংস্কার

যুদ্ধের উসকানিমূলক বক্তৃতা ও সামরিক প্রস্তুতির মধ্যেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না। তাঁরা চায় শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত হবে জনতার অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণার স্বর শুনে তাতেই মনোযোগী হওয়া।

যখন সীমান্তে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, তখন পাকিস্তানি পরিবারগুলো গুলি নয়, নিত্যপণ্যের দাম কমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button