অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় নির্বাচনে, এগিয়ে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ

অস্ট্রেলিয়ায় আজ শনিবার (৩ মে ২০২৫) অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয় এবং বিকেল পর্যন্ত চলবে। দেশটির নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, এবারের নির্বাচনে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ ভোটার অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক প্রায় ৮০ লাখ ভোটার ইতিমধ্যেই আগাম ভোট দিয়ে দিয়েছেন।
জনমত জরিপে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল লিবারেল-ন্যাশনাল জোটের নেতা পিটার ডাটনের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। ভোটারদের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয়, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসনব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি এবং অস্থির কূটনৈতিক কৌশল অস্ট্রেলীয় ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগাম ভোটের রেকর্ড
অস্ট্রেলিয়ায় এবারের নির্বাচন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। প্রায় ৮০ লাখ মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন, যা এককথায় রেকর্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ভোটদান পদ্ধতির সহজলভ্যতার পরিচায়ক। অস্ট্রেলিয়ার ৮৩টি দেশে বিদেশি ভোটারদের জন্য ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার প্রবাসী অস্ট্রেলীয় নাগরিক ভোট দিচ্ছেন।
লেবার সরকারের অর্জন ও লক্ষ্য
ভোটগ্রহণ শুরুর আগে মেলবোর্নে এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেন, “আমাদের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। এখন সময় হয়েছে মেডিকেয়ার স্বাস্থ্যসেবা এবং আবাসনব্যবস্থায় আমাদের প্রতিশ্রুত উন্নয়নগুলো বাস্তবায়নের।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে যেতে চাই।”
লেবার পার্টি এবার তাদের প্রচারণায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ‘মেডিকেয়ার’ তথা অস্ট্রেলিয়ার সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন সুবিধা তৈরি করার প্রতিশ্রুতিতে।
ডাটনের কৌশল ও চ্যালেঞ্জ
অন্যদিকে, লিবারেল-ন্যাশনাল জোটের নেতা পিটার ডাটন ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন “দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার” জন্য তাঁর দলকে ভোট দিতে। তিনি বলেন, “লেবার সরকারের অধীনে অস্ট্রেলীয়দের জীবনযাত্রার মান নজিরবিহীনভাবে কমেছে।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি এই বার্তা পোস্ট করে জানান, লেবার পার্টি ব্যয়বহুল নীতির কারণে জনগণ চাপে পড়েছে।
ডাটন নির্বাচিত হলে সরকারি ব্যয়ের কাটছাঁট এবং সরকারি চাকরির পরিমাণ হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে নির্বাচনী প্রচারে তাঁর একটি বড় ভুল ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন—সরকারি কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করার সুবিধা বন্ধের প্রস্তাব। এটি অনেক ভোটারের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও তার প্রভাব
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি নিয়ে অস্ট্রেলীয় ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। ট্রাম্প অস্ট্রেলিয়ার ওপর ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন, যদিও দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সিদ্ধান্ত অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে চাপ ফেলছে এবং এটি নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
লেবার পার্টি প্রচারণায় ডাটনকে ‘ট্রাম্প ঘরানার রক্ষণশীল নেতা’ হিসেবে তুলে ধরছে, যাতে ট্রাম্পের প্রতি অস্ট্রেলীয়দের নেতিবাচক মনোভাবের সুবিধা তারা নিতে পারে।
জনমত জরিপ কী বলছে?
নির্বাচনের আগের দিন শুক্রবার ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, লেবার পার্টি ৫২.৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে, যেখানে লিবারেল-ন্যাশনাল জোট পেতে পারে ৪৭.৫ শতাংশ। এটি বোঝায়, লেবার সামান্য এগিয়ে থাকলেও তাদের জয় নিশ্চিত নয়।
একাধিক জরিপে ইঙ্গিত মিলেছে, লেবার পার্টিকে এবার সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে হতে পারে। এতে ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রভাব
জনমত বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান রয় মর্গানের প্রধান নির্বাহী মিশেল লেভিন জানিয়েছেন, ২০০৭ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে স্বতন্ত্র ও ছোট দলের ভোটের হার দ্বিগুণ হয়েছে। তিনি বলেন, “এবারের নির্বাচনেও প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার প্রধান দুই দলের বাইরের কাউকে ভোট দেবেন।”
২০২২ সালের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, লেবার পেয়েছিল ৩২.৬ শতাংশ, লিবারেল-ন্যাশনাল জোট ৩৫.৭ শতাংশ এবং অন্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিল ৩১.৭ শতাংশ ভোট।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নির্বাচন এবার অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে রয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে রয়েছে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব—বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে চান, যেখানে তিনি স্বাস্থ্য ও আবাসন খাতে উন্নয়ন প্রতিশ্রুত। আর পিটার ডাটন চাচ্ছেন দেশে কাঠামোগত পরিবর্তন এনে ব্যয় হ্রাস করতে।
তবে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করছে ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অবস্থান এবং শেষ মুহূর্তের ভোটপ্রবাহের ওপর। তাই বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে আগামী দিনগুলো হবে অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ ও সিদ্ধান্তমূলক।