গাজার উদ্দেশে ত্রাণ নিয়ে যাত্রা করা জাহাজে বোমা হামলা

মানবিক সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিনের গাজার উদ্দেশে যাত্রারত একটি জাহাজে ড্রোন দিয়ে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ ইউরোপের দেশ মাল্টার আন্তর্জাতিক জলসীমায় এই হামলায় জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিকল হয়ে পড়েছে। হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ত্রাণ কার্যক্রমের আয়োজক সংগঠন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)। তবে ইসরায়েল এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
শুক্রবার (২ মে) এক বিবৃতিতে এফএফসি জানিয়েছে, নিরস্ত্র বেসামরিক জাহাজটির সম্মুখভাগে দুটি সশস্ত্র ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে জাহাজের সামনের অংশে আগুন ধরে যায় এবং কাঠামোয় বড় ধরনের ফাটল ও গর্তের সৃষ্টি হয়। শুক্রবার ভোরে জাহাজের জেনারেটর লক্ষ্য করে অতিরিক্ত হামলার কারণে এটি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে, যা জাহাজটির ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের পোস্ট করা ছবি ও ভিডিওতে জাহাজের ওপর আগুন জ্বলতে এবং বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা গেছে।
জাহাজটি বর্তমানে মাল্টা উপকূল থেকে ১৪ নটিক্যাল মাইল (২৫ কিলোমিটার) দূরে অবস্থান করছে। এতে গাজাবাসীদের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীর পাশাপাশি ২১টি দেশের অধিকারকর্মীরা ছিলেন। এফএফসি জানিয়েছে, ইসরায়েলের গাজা অবরোধ এবং সেখানে চলমান হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এবং গাজার অসহায় বাসিন্দাদের জীবন রক্ষার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তারা এই যাত্রা শুরু করেছিলেন।
মাল্টা সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জাহাজে ১২ জন নাবিক ও ৪ জন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন, এবং তারা সবাই সুস্থ আছেন। জাহাজটিকে সহায়তা করার জন্য কাছাকাছি অবস্থানরত একটি টাগ বোটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাল্টা সরকারের তথ্য দপ্তরের দেওয়া ছবিতে দেখা গেছে, টাগ বোট থেকে জাহাজে আগুন নেভানোর জন্য পানি দেওয়া হচ্ছে।
এফএফসি তাদের বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, “আমাদের জাহাজটি সম্পূর্ণ বেসামরিক ও নিরস্ত্র ছিল। গাজার অসহায় ফিলিস্তিনিদের জন্য খাবার ও ত্রাণসামগ্রী ছিল এতে। এ ধরনের হামলায় আমাদের সদস্যদেশের প্রতিনিধিদের প্রাণহানি ঘটতে পারত।” সংগঠনটি আরও দাবি করেছে, গাজায় চলমান অবরোধ এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের জাহাজে বোমা হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তারা ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতদের তলব করে এই ঘটনার জবাবদিহি দাবি করেছে।
গাজার মানবিক সংকট
ইসরায়েল গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু করেছে। এরপর থেকে গাজা উপত্যকা কঠোর অবরোধের মুখে পড়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ এবং অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী গাজায় প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। ফলে গাজার বাসিন্দারা চরম খাদ্য সংকট, ওষুধের অভাব এবং জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছে।
গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, তাদের মজুদ করা খাদ্যপণ্য ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। গাজার কর্মকর্তারা শুক্রবার জানিয়েছেন, দুর্গতদের জন্য খাবার সরবরাহকারী রান্নাঘরগুলো আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে গাজার জনগণের জন্য ত্রাণ পৌঁছানো এখন জরুরি প্রয়োজন।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গাজায় পাঠানো মানবিক সহায়তা হামাস সদস্যরা চুরি করে তাদের যোদ্ধাদের সরবরাহ করে বা বিক্রি করে দেয়। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ত্রাণ কার্যক্রমে জড়িত সংস্থাগুলো। তারা জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গাজায় ত্রাণ চুরির কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি।
ফ্রিডম ফ্লোটিলার ইতিহাস
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন দীর্ঘদিন ধরে গাজার অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সেখানকার জনগণের জন্য ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে আসছে। এর আগে ২০১০ সালে তুরস্ক থেকে গাজার উদ্দেশে ত্রাণ নিয়ে যাত্রা করা তাদের জাহাজ মাভি মারমারায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ওই হামলায় ১০ জন নিহত এবং ২৮ জন আহত হয়েছিলেন। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিয়েছিল।
বর্তমান হামলার ঘটনাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সুইডিশ পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ রয়টার্সকে জানিয়েছেন, তিনি মাল্টায় ছিলেন এবং ফ্রিডম ফ্লোটিলার গাজার সমর্থনে পরিকল্পিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাহাজে উঠার কথা ছিল। কিন্তু হামলার কারণে তিনি তা করতে পারেননি। তিনি জাহাজটির বর্তমান বিপদজনক অবস্থার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গাজার চলমান সংঘাত
গাজার বর্তমান সংঘাতের শুরু গত বছরের অক্টোবরে, যখন হামাস সদস্যরা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়। এর পর থেকে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে। যুদ্ধবিরতির কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি চুক্তি সত্ত্বেও, মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইসরায়েল আবারও তীব্র হামলা শুরু করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই দফার হামলায় অন্তত ২,৩২৬ জন নিহত হয়েছেন, এবং মোট নিহতের সংখ্যা ৫২,৪১৮ জনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এই হামলা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে অসহনীয় দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি যুদ্ধবিরতি মেনে চলা, ত্রাণসহায়তার প্রবেশে বাধা না দেওয়া এবং জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
এই হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো গাজায় চলমান অবরোধ এবং মানবিক সংকটের সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
গাজার বাসিন্দারা যখন খাদ্য, ওষুধ এবং জীবনরক্ষাকারী সামগ্রীর অভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এই হামলা ত্রাণ সরবরাহের প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন প্রশ্ন, কীভাবে গাজার মানবিক সংকট মোকাবিলা করা যায় এবং এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।