সংগ্রামী জীবন থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব: অস্ট্রেলিয়ার নেতা অ্যান্থনি অ্যালবানিজ

অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চ এখন উত্তপ্ত। ৩ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সাধারণ নির্বাচন, যার দৌড়ে মুখোমুখি লেবার পার্টি ও লিবারেল-ন্যাশনাল জোট। ভোটের ঠিক আগমুহূর্তে জনগণের চোখ এখন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের দিকে। আর এই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে শুধু তাঁর নেতৃত্ব নয়, বরং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং শূন্য থেকে উঠে আসার গল্পও।
টিনের ছাউনি থেকে শীর্ষ ক্ষমতার মসনদে
১৯৬৩ সালের এক শীতের সকাল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ডার্লিংহার্স্ট এলাকার একটি সরকারি অনুদানের ফ্ল্যাটে জন্ম নেন অ্যান্থনি নরমান অ্যালবানিজ। তাঁর মা ম্যারিয়ান এলিরি ছিলেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এবং একাই ছেলেকে লালন-পালন করেন। বাবার উপস্থিতি ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন ইতালীয় নাবিক, যিনি অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ করার পর আর ফিরে আসেননি। মায়ের পেনশন ও সরকারি সহায়তায় চলা এক সংকটপূর্ণ জীবনের শুরু।
পড়ালেখার খরচ মেটাতে পত্রিকা বিক্রি
ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম ছিল অ্যালবানিজের জীবনের অংশ। ক্যাম্পারডাউনের সরকারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা এবং পরে সেন্ট মেরিজ ক্যাথলিক কলেজে পড়াশোনা। তবে শিক্ষার খরচ জোগাতে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে পত্রিকা বিক্রেতা ও রেস্তোরাঁর খণ্ডকালীন কর্মী হিসেবে। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান এবং ১৯৮৪ সালে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনীতির মঞ্চে আত্মপ্রকাশ
মধ্য-বামপন্থী লেবার পার্টির রাজনীতিতে জড়ান অ্যালবানিজ। ১৯৯৬ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের গ্রেইন্ডলার আসন থেকে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন। প্রথম ভাষণেই তিনি বলেছিলেন, “আমি শুধু আমার এলাকার মানুষের নয়, সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের উন্নয়নে কাজ করতে চাই।” এই বক্তব্যই ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দর্শন গঠনে সহায়ক হয়।
সমাজ পরিবর্তনের পুরোধা
অ্যালবানিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নানা সামাজিক সংস্কার রয়েছে। সমকামী দম্পতির অবসর সুবিধা নিশ্চিতকরণ, প্রতিবন্ধীদের জন্য জাতীয় বীমা প্রকল্প, ইনফ্রাস্ট্রাকচার অস্ট্রেলিয়া গঠন—এসবই তাঁর হাত ধরে বাস্তবায়িত হয়। ২০০৭ সালে অবকাঠামো মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
২০২২: অভাবী ছেলের প্রধানমন্ত্রিত্বে অভিষেক
২০২২ সালের ২৩ মে ইতিহাস রচনা করেন অ্যালবানিজ। সরকারি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেই ছেলেটিই শপথ নেন অস্ট্রেলিয়ার ৩১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বে লেবার সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, আদিবাসী জনগণের অধিকার, নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারসহ নানা কার্যক্রম শুরু করে।
ব্যক্তিজীবনে নতুন অধ্যায়
২০১৯ সালে দীর্ঘ ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটান অ্যালবানিজ। এরপর ২০২০ সালে এক অনুষ্ঠানে জোডি হেডেনের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম। ২০২৪ সালের ভালোবাসা দিবসে তাঁদের বাগদান হয়, যা ক্ষমতাসীন অবস্থায় কোনো অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রথম বাগদানের ঘোষণা।
বাবার সন্ধানে ইতালিতে যাত্রা
শৈশব থেকে বাবার অনুপস্থিতি ও পরিচয়হীনতা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। বড় হয়ে তিনি নিজেই খুঁজে বের করেন তাঁর ইতালীয় বাবাকে। বাবা-ছেলের পুনর্মিলন তাঁর জীবনবোধে গভীর মানবিকতা যোগ করে।
অ্যালবানিজ প্রায়ই বলেন,
“আমি চাই অস্ট্রেলিয়া এমন এক দেশ হোক, যেখানে কোনো শিশুর জন্মপরিস্থিতি, ধর্মবিশ্বাস বা নামের শেষাংশ তার সামনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।”
বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
অ্যালবানিজের নির্বাচনী এলাকা গ্রেইন্ডলারসহ আশপাশের অঞ্চলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয়দের বসবাস উল্লেখযোগ্য হারে। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২২ সালের জয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা দেয়। এবারও তাঁর প্রচারণায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা বড় ভূমিকা রাখছেন।
নির্বাচন ২০২৫: কী বলছে জনমত?
নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে—লেবার পার্টি সামান্য এগিয়ে আছে। তবে শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, অ্যান্থনি অ্যালবানিজের ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও নিরবিচারে জনসেবার ভাবমূর্তি তাঁকে ভোটারদের কাছে আলাদা জায়গায় নিয়ে গেছে।
অ্যান্থনি অ্যালবানিজের জীবন হলো এক সংগ্রামী পথচলার অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি। সরকারি সহায়তায় বেড়ে ওঠা এক ছেলে, যিনি আজ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া যেন আরও মানবিক, সমতা-ভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে পরিণত হচ্ছে।