বিশ্ব

গাজাযুদ্ধ বন্ধের আহ্বানন ইসরায়েলি সেনাদের, নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে

ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতাও তীব্র আকার ধারণ করছে। এবার দেশটির সামরিক বাহিনীর সংরক্ষিত সেনা সদস্যরা সরাসরি যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। তাঁরা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে জিম্মিদের মুক্তির লক্ষ্যে চুক্তিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

হাজারো ইসরায়েলি সেনার খোলাচিঠি: যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান

গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের সব সামরিক শাখার প্রায় ১২ হাজার সংরক্ষিত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা একটি খোলাচিঠিতে স্বাক্ষর করে স্পষ্টভাবে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন, “এ যুদ্ধ জিম্মিদের মুক্তি নয়, বরং তাঁদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা আরও উল্লেখ করেন, “প্রতিটি নতুন দিন গাজায় থাকা জিম্মিদের জীবনকে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলছে। এখন প্রতিটি মুহূর্তের দ্বিধা জাতির জন্য অপমানজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

সাবেক গোয়েন্দা প্রধানের কড়া মন্তব্য

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতমও এ চিঠিতে সই করেছেন। তিনি বলেন,
“আমি প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছি রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে। আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন—আমার দেশ ভুল পথে হাঁটছে।”

তিনি আরও বলেন, নেতানিয়াহু সরকার জিম্মিদের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না, বরং নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধকে ব্যবহার করছেন।

সেনা প্রত্যাখ্যান বাড়ছে, সংকটে সামরিক বাহিনী

ইসরায়েলি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, বর্তমানে সংরক্ষিত সেনা ডাকার পরও সাড়া দেওয়ার হার ৫০-৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধের পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

একজন পদাতিক সংরক্ষিত সেনা, ছদ্মনামে ইয়োভ, বলেন,
“আমি বিশ্বাস করতাম আমরা ভালো কিছু করছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমরা আমাদের দেশের নৈতিক ভিত্তিকেই নষ্ট করছি।”

তিনি আরও বলেন,
“হামাসকে পরাজিত করা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের দেশকে রক্ষা করা এবং আমাদের মূল্যবোধ ধরে রাখা।”

অভ্যন্তরীণ মতভেদ ও বিক্ষোভ বাড়ছে

তেল আবিবে প্রতিদিনই চলমান সরকারবিরোধী ও যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন হাজারো ইসরায়েলি নাগরিক। জিম্মিদের ছবি ও গাজায় নিহত শিশুদের ছবি নিয়ে তাঁরা রাস্তায় অবস্থান করছেন। অনেকের মতে, এই আবেগঘন বিক্ষোভ ও সেনাদের খোলাচিঠি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে অস্বস্তিতে ফেলছে।

সামরিক আদেশ অমান্যের আহ্বান

ইসরায়েলের উদারপন্থী সংবাদপত্র হারেতজ-এ অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আমিরাম লেভিন এক কলামে লিখেছেন,
“যুদ্ধাপরাধে জড়ানোর আশঙ্কা এতটাই বেড়েছে যে এখন সেনাদের উচিত প্রয়োজন হলে উচ্চপদস্থ কমান্ডারের আদেশ অমান্য করাও।”

তিনি বলেন, চুপ করে বসে থাকা এখন আর সম্ভব নয়। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সামাজিক মূল্যবোধ চরম হুমকির মুখে।

নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়া

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এসব সমালোচনাকে ‘অপপ্রচারমূলক মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এসব ছড়াচ্ছেন “বিচ্ছিন্ন কিছু পেনশনভোগী, যারা বহু বছর ধরে সেনাবাহিনীতে নেই।” নেতানিয়াহু বরাবরের মতোই তার সরকারের অবস্থানকে সঠিক দাবি করে বলেছেন, “ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস করা যাবে না।”

জনমত কোন দিকে?

তবে জনমত জরিপগুলো ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। অধিকাংশ ইসরায়েলি এখন বিশ্বাস করেন, জিম্মিদের মুক্ত করাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, যুদ্ধ নয়। বিশেষ করে জানুয়ারি মাসে স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ৩০ জন জিম্মি মুক্ত হওয়ার পর অনেকেই আশা করেছিলেন যে শান্তি সম্ভব।

কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি যুদ্ধবিরতি ভেঙে পুনরায় ভয়াবহ হামলা শুরুর পর সে আশা ভেঙে যায়। ফলে দেশের ভেতরে শান্তিকামী ও মানবিক চিন্তাভাবনার মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।


ইসরায়েলের ইতিহাসে এমন সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ মতভেদ এবং সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান নেওয়ার ঘটনা বিরল। হাজারো সংরক্ষিত সেনা এখন সরাসরি যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন, যা নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিক ও কৌশলগত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জনমতের ঢেউ যদি অব্যাহত থাকে, তবে নেতানিয়াহুর সরকারকে কৌশল বদলাতেই হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button