বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি মারা গেছেন

ব্রাজিলের ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী ইনাহ কানাবারো লুকাস, যিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তি, মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১১৬ বছর। তিনি ১৯০৮ সালের ৮ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
বিশ্বব্যাপী মানবজীবনের দীর্ঘায়ু পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেরন্টোলজিক্যাল রিসার্চ গ্রুপ (জিআরজি) এবং লংজেভিকোয়েস্ট কর্তৃক তাঁর দীর্ঘায়ু ও মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
ব্রাজিলের ধর্মীয় সংগঠন দ্য কংগ্রেগেশন অব টেরেসিয়ান সিস্টার্স অব ব্রাজিল বুধবার এক বিবৃতিতে ইনাহ কানাবারোর মৃত্যুর কথা জানায়। বিবৃতিতে তাঁরা এই প্রবীণ সন্ন্যাসিনীর জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “তিনি ছিলেন আমাদের জন্য আত্মত্যাগ ও নিবেদনের প্রতীক। তাঁর শান্ত প্রস্থানে আমরা শোকাহত হলেও তাঁর জীবনের দর্শন আমাদের অনুপ্রাণিত করে যাবে।”
শৈশব থেকেই সংগ্রামের জীবন
ইনাহ কানাবারোর জীবন শুরু হয়েছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। ছোটবেলায় তিনি বেশ রোগাক্রান্ত ছিলেন এবং তখন অনেকে মনে করতেন তিনি হয়তো বেশিদিন বাঁচবেন না। লংজেভিকোয়েস্ট এক শোকবার্তায় জানিয়েছে, “তিনি ছিলেন অসুস্থ, রোগা এবং দুর্বল। কিন্তু সেই সময়ের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি বেঁচে যান। এবং সেই ঘটনাকে তিনি ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতার এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখতেন।”
একবার মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা তাঁর সারা জীবন বিশ্বাস ও সেবার পথে চালিত করেছে। সে সময় থেকেই তিনি অনুভব করতেন যে, তাঁর জীবন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হবে।
সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ
১৯৩৪ সালে, মাত্র ২৬ বছর বয়সে, ইনাহ কানাবারো সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের এই সিদ্ধান্ত তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। সেই থেকে শুরু হয় তাঁর সন্ন্যাসজীবন, যা ছিল প্রার্থনা, শিক্ষা, সেবা ও আত্মত্যাগে পূর্ণ।
তিনি প্রায় ৯০ বছর সন্ন্যাসজীবনে কাটিয়েছেন। ব্রাজিলের বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষাদান করেছেন এবং বিশেষ করে দরিদ্র ও অবহেলিতদের মধ্যে সেবা দিয়েছেন।
পোপের আশীর্বাদ ও দীর্ঘজীবনের রহস্য
২০২৩ সালে ১১০তম জন্মদিনে তিনি পোপ ফ্রান্সিসের কাছ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস তখন তাঁকে ‘আধ্যাত্মিক অধ্যবসায় ও মানবিকতা’র প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
নিজের দীর্ঘজীবন সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে ইনাহ কানাবারো বলেছিলেন, “ঈশ্বরই জীবনের গোপন রহস্য। সবকিছুর রহস্য তিনিই। আমি শুধু তাঁর পথ অনুসরণ করেছি।”
তিনি প্রতিদিন নিয়মিত প্রার্থনা করতেন, সুশৃঙ্খল খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতেন এবং মানসিকভাবে শান্ত থাকতেন। এই তিনটি বিষয়ই তাঁর দীর্ঘায়ুর প্রধান ভিত্তি বলে মনে করা হয়।
জন্মতারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি
ইনাহ কানাবারো নিজের দাবি অনুযায়ী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০৮ সালের ২৭ মে। কিন্তু জিআরজি পরিচালক রবার্ট ইয়াং জানান, সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী তাঁর প্রকৃত জন্মতারিখ ১৯০৮ সালের ৮ জুন।
বয়স নির্ধারণে এমন অসঙ্গতি প্রায়ই দেখা যায়, বিশেষ করে শতবর্ষী বা তার অধিক বয়সী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। কারণ, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থায় যথাযথ রেকর্ড সংরক্ষণের অভাব ছিল।
ইতিহাসে স্থান
লংজেভিকোয়েস্টের তথ্য অনুযায়ী, ইনাহ কানাবারো হলেন ইতিহাসে নথিভুক্ত ১৫তম দীর্ঘজীবী ব্যক্তি। সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি দ্বিতীয় দীর্ঘজীবী, প্রথমজন হলেন ফ্রান্সের লুসিল র্যান্ডন, যিনি ২০২৩ সালে ১১৮ বছর বয়সে মারা যান।
তাঁর আগে বিশ্বের সবচেয়ে বয়সী ব্যক্তি ছিলেন জাপানের তোমিকো ইতোকা। তিনি চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১১৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
নতুন প্রবীণতম ব্যক্তি
ইনাহ কানাবারোর মৃত্যুর পর বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন ইংল্যান্ডের সারে অঞ্চলের বাসিন্দা এথেল ক্যাটারহ্যাম। তাঁর বয়স ১১৫ বছর।
এই তথ্যও নিশ্চিত করেছে জিআরজি এবং লংজেভিকোয়েস্ট। তাঁরা জানিয়েছেন, এথেল বর্তমানে শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন এবং পারিবারিক সান্নিধ্যে অবসর জীবন উপভোগ করছেন।
মানবজীবনের দীর্ঘায়ু ও গবেষণা
বয়সের সীমা অতিক্রম করে এমন মানুষের জীবন নিয়ে চিকিৎসা, জীবনধারা ও জেনেটিক গবেষণার ক্ষেত্রগুলোতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। ইনাহ কানাবারোর মতো ব্যক্তিরা সেই গবেষণাকে অনুপ্রাণিত করে, কারণ তাঁদের জীবন থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া যায়—কীভাবে দীর্ঘজীবন শুধু বয়সের সংখ্যা নয়, বরং মানসিক শান্তি, আত্মিক শক্তি এবং সঠিক জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি।
ইনাহ কানাবারো লুকাসের জীবন ছিল আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে নিরলস সেবা, আত্মত্যাগ ও অধ্যবসায়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর দীর্ঘজীবন কেবল একটি সংখ্যাই নয়, এটি ছিল এক প্রেরণামূলক কাহিনি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।