তহবিল সংকটে বন্ধ হচ্ছে ১৮০ বছর পুরোনো লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটি

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটি আর এক সেমিস্টার পরই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৮০ বছর ধরে শিক্ষা প্রদানের পর এবার তহবিল সংকটে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাফনি ক্যাম্পাস এবং অনলাইন প্রোগ্রামগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল। তবে জোরালো তহবিল সংগ্রহ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা মাত্র ২ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহে সক্ষম হয়, যা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে ট্রাস্টি বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান র্যান্ডাল রিচার্ডসন বলেন, “লাইমস্টোনের আত্মা আমাদের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়ে যাবে। তারা বিশ্বব্যাপী এর ঐতিহ্য বহন করবে। যদিও এই দরজাগুলো বন্ধ হচ্ছে, কিন্তু লাইমস্টোনের প্রভাব চিরকাল থাকবে।”
হঠাৎ ঘোষণা, গভীর হতাশা
২০২৫ সালের এপ্রিলের শুরুতে লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটি হঠাৎ করেই ঘোষণা করে যে, তারা ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং যদি অতি দ্রুত ৬ মিলিয়ন ডলার না পাওয়া যায়, তবে তাদের বন্ধ হয়ে যেতে হবে। এই ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থী, প্রাক্তনী, শিক্ষকমণ্ডলী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চরম হতাশা ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড্যারেল পার্কিনস বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অনুদান, দাতব্য উদ্যোগ এবং সম্ভাব্য আর্থিক সহায়তার সব পথ অনুসন্ধান করেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তহবিলের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়।”
ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রবল চাপ
গত এক দশকে লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। ২০১০ সালের তুলনায় বর্তমানে সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ভর্তি হ্রাসের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয়ও তলানিতে ঠেকে, যা তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা আরোপ করছিল। শিক্ষক ছাঁটাই, পাঠ্যসূচি হ্রাস, ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়ন স্থগিত – এসব কিছুই ছিল আর্থিক সংকট সামাল দেওয়ার অংশ।
কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠানটি বারবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছিল। ২০২৪ সাল থেকে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করে এবং ২০২৫ সালে এসে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং ভূমিকা
লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটি ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দক্ষিণ ক্যারোলিনার প্রাচীনতম বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্যারোলিনার গ্যাফনি শহরে অবস্থিত এবং দীর্ঘদিন ধরে একটি আঞ্চলিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত মুক্তবুদ্ধি ও উদার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে পরিচালিত হতো। আর্টস, সায়েন্স, বিজনেস, নার্সিং এবং অনলাইন শিক্ষায়ও এটি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। অনলাইন প্রোগ্রাম চালু করে বহু দূরবর্তী ও চাকরিজীবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষার সুযোগ করে দেয় লাইমস্টোন।
এই প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ ক্যারোলিনায় নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯ শতকে নারীদের শিক্ষা সীমিত থাকার সময়েও লাইমস্টোন নারীদের জন্য ক্যাম্পাসে পড়ার সুযোগ দিয়েছিল।
শিক্ষার্থী ও প্রাক্তনীদের প্রতিক্রিয়া
লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটির বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে হাজারো প্রাক্তনী ও বর্তমান শিক্ষার্থী সামাজিক মাধ্যমে শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জেসিকা হেনরি নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, “লাইমস্টোন শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা ছিল আমাদের পরিবার। এখান থেকে শুধু শিক্ষা নয়, জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার প্রতিটি উপাদান পেয়েছি। এখন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আর থাকবে না।”
এক প্রাক্তনী ও বর্তমানে শিক্ষক জন স্মিথ বলেন, “আমরা এই খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছি। বহু দশক ধরে এই প্রতিষ্ঠান সমাজে নেতৃত্ব তৈরির কাজ করেছে। এটা শুধু গ্যাফনির নয়, গোটা অঞ্চলের ক্ষতি।”
শিক্ষা ক্ষেত্রের দৃষ্টিভঙ্গি
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের অবসান নয়, বরং এটি একটি বড় সংকেত যে, ছোট এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বহু প্রাইভেট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে শিক্ষার্থী সংকট, উচ্চ পরিচালন ব্যয়, সরকারি সহায়তার অভাব এবং অনুদান কমে যাওয়ার কারণে একই ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, শিক্ষাব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন, অনলাইন শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষার্থীদের প্রথাগত ডিগ্রির প্রতি আগ্রহ হ্রাস এবং কর্মমুখী শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়া – এসবই এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
ভবিষ্যতের ব্যবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য ট্রান্সফার চুক্তি করা হয়েছে দক্ষিণ ক্যারোলিনার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের ডিগ্রি শেষ করতে পারেন, সে জন্য একাধিক কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া অনলাইন শিক্ষার্থীদের জন্যও ট্রান্সফার প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কর্মরত শতাধিক শিক্ষক ও কর্মচারীদের ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত।
উপসংহার
লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটির বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি যুগের অবসান। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে দক্ষিণ ক্যারোলিনার শিক্ষাক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে, আজ তা আর্থিক অচলাবস্থায় হারিয়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিক্ষার মতো মৌলিক খাতেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কতটা জরুরি। লাইমস্টোন ইউনিভার্সিটি হয়তো আর থাকবে না, তবে এর উত্তরাধিকার, প্রভাব এবং শিক্ষার চেতনা অনন্তকাল ধরে বহমান থাকবে যারা এর অংশ ছিলেন – তাদের হৃদয়ে ও কর্মে।