গাজা সীমান্তে ৩ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশে বাধা ইসরায়েলের

ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত থাকায় চরম মানবিক সংকটে পড়েছে গাজা উপত্যকার লাখো বাসিন্দা। জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজা সীমান্তে প্রায় ৩ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে রেখেছে ইসরায়েল, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। এই সহায়তা না পৌঁছালে গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে সংস্থাটি।
সীমান্তে আটকে থাকা ত্রাণ
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (১ মে) জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ গাজার ভেতরে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। গাজা সীমান্তে অপেক্ষমাণ এই সহায়তাবাহী ট্রাকগুলোতে রয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে ইউএনআরডব্লিউএ (ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা)-র পাঠানো খাদ্য ও জরুরি সহায়তা। এগুলোর প্রবেশে বাধা দিলে গাজায় আরও বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
১০ লাখ শিশু ঝুঁকিতে
জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই ত্রাণ সহায়তার ওপর গাজার অন্তত ১০ লাখ শিশু নির্ভরশীল। সহায়তা প্রবেশে বাধা দিলে শিশুদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। গাজা ইতোমধ্যেই খাদ্য, পানি ও ওষুধ সংকটে বিপর্যস্ত। হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, “গাজার শিশুরা প্রতিদিন না খেয়ে ঘুমাতে যাচ্ছে। বহু শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। যদি এই ত্রাণ সহায়তা অবিলম্বে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে গাজা দুর্ভিক্ষের পূর্ণমাত্রিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে।”
ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা
ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে তারা প্রতিটি ত্রাণবাহী ট্রাককে যাচাই-বাছাই করে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ ট্রাকই দিনের পর দিন সীমান্তে আটকে থাকছে এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, “আমরা মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখার পক্ষেই রয়েছি, তবে আমাদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রতিটি চালান যাচাই করতে হচ্ছে।” যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে, এসব অজুহাত দিয়ে ইসরায়েল কার্যত ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং গাজার জনগণকে একটি পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলোর আহ্বান
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ও এনজিও ইসরায়েলকে ত্রাণ প্রবেশে দ্রুত ছাড় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, “আমরা প্রস্তুত আছি, একবার প্রবেশাধিকার পেলে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ অবিলম্বে শুরু করতে পারব।”
ইউএনআরডব্লিউএ-এর মুখপাত্র জানান, “গাজায় সহায়তা পাঠানোর মতো অবকাঠামো এখনও আছে। আমরা জানি কোথায়, কীভাবে, কার কাছে সহায়তা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু প্রবেশাধিকার না পেলে আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
মানবিক সংকটের গভীরতা
গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর একটি। চলমান ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, বহু শিশু আহত হয়েছে এবং লাখো মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু অবস্থায় রয়েছে। খাবার, পানি, ওষুধের পাশাপাশি নিরাপদ আশ্রয়েরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং শিক্ষাজনিত স্থায়ী ক্ষতি দেখা দেবে। একইসঙ্গে নারীদের জন্যও পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে, বিশেষ করে গর্ভবতী ও সদ্য মা হওয়া নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা অনুপস্থিত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বহু দেশ গাজায় ত্রাণ প্রবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাস্তবে এই আহ্বানগুলোর বাস্তবায়ন খুবই ধীরগতির। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বারবার আলোচনা হলেও কার্যকর কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। অনেকেই বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই ব্যর্থতা গাজার জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা বলেন, “গাজা এখন একটি খোলা কারাগারে পরিণত হয়েছে। মানুষ বাঁচার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”
ত্রাণ প্রবেশে সম্ভাব্য বিকল্প পথ
বিভিন্ন সংস্থা এখন বিকল্প পথে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের উপায় খুঁজছে। মিশরের রাফাহ সীমান্ত পয়েন্ট, যার মাধ্যমে অতীতে কিছু ত্রাণ প্রবেশ করেছে, সেটিও বর্তমানে ইসরায়েলি নজরদারির কারণে বন্ধ প্রায়। এই পরিস্থিতিতে আকাশপথে ত্রাণ পৌঁছানোর সম্ভাবনাও আলোচনায় এসেছে, যদিও ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এটিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
একাধিক মানবাধিকার সংস্থা বলছে, ইসরায়েল যদি আন্তর্জাতিক চাপেও মানবিক সহায়তার পথ না খুলে দেয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প করিডোর খোলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।