ইসরায়েলে দাবানল পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপে

ইসরায়েলে ভয়াবহ দাবানলের কবলে পড়েছে রাজধানী জেরুজালেমের আশপাশের এলাকা। প্রচণ্ড বাতাস ও খরার কারণে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন, ফলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। ইতোমধ্যে শত শত মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জেরুজালেমের পশ্চিমাংশে দাবানলের ভয়াবহতা
গত ৩০ এপ্রিল (বুধবার) ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমের পশ্চিমাংশে অবস্থিত নেভে ইলান এবং আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এই দাবানল। ঘন ধোঁয়া এবং দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মধ্যে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। শুষ্ক আবহাওয়া এবং ঘণ্টায় ৯৫ কিলোমিটার গতির বাতাস পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলি ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ সার্ভিস জানায়, প্রায় ১২০টি অগ্নিনির্বাপণ দল এবং ১২টি বিমান ও হেলিকপ্টার দাবানল নেভাতে কাজ করছে। আকাশপথে আগুনের ওপর পানি ঢালা হচ্ছে। মাটিতে চলছে সড়কভিত্তিক অভিযান।
জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা, আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্তজ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা এখন জাতীয় জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছি। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের সব বাহিনীকে সক্রিয় হতে হবে।” তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদন সার ইতালি ও মেসিডোনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জানিয়েছে, দুই দেশ থেকেই তিনটি অগ্নিনির্বাপণ বিমান ইসরায়েলে পৌঁছাতে চলেছে।
নেভে শালম শহরের আশপাশে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা
জেরুজালেম থেকে প্রায় ১৫ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত নেভে শালম শহরের চারপাশে দাবানলের ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি সড়কের পাশে আগুন জ্বলছে আর সেখানে গাড়ির দীর্ঘ সারি আটকে আছে। মানুষজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবং আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, উদ্ধারকর্মীরা মহাসড়কে পরিত্যক্ত গাড়িগুলোর ভিতরে কেউ আটকে আছেন কিনা তা খুঁজে দেখছেন।
রুট ১ মহাসড়ক বন্ধ, মেমোরিয়া ডে উদ্যাপন ব্যাহত
জরুরি ভিত্তিতে তেল আবিব ও জেরুজালেমের সংযোগকারী প্রধান সড়ক ‘রুট ১’ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ৩০ এপ্রিল ছিল ইসরায়েলের জাতীয় মেমোরিয়া ডে, যা এখন এই দুর্যোগের কারণে আংশিকভাবে স্থগিত হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালগুলোতে জরুরি অবস্থা, আহত অন্তত ১৩ জন
এই দাবানলের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও, গুরুতর দগ্ধদের আশপাশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হয়েছে।
শামির মেডিকেল সেন্টার এবং কপলান মেডিকেল সেন্টার জানায়, অন্তত ডজনখানেক মানুষকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে, হাদাসা মেডিকেল সেন্টার কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষকে অনুরোধ করেছে, কেউ যেন ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া হাসপাতালে না আসে। এছাড়া যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন কিন্তু অবস্থা গুরুতর নয়, তাদের স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ: সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি গ্রেপ্তার
এই দাবানলের পেছনে মানবসৃষ্ট কারণ রয়েছে কিনা, তা নিয়েও তদন্ত শুরু করেছে ইসরায়েলি পুলিশ। পুলিশ জানায়, পূর্ব জেরুজালেমের উম তুবা এলাকা থেকে ৫০ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, তাকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে একটি খোলা মাঠে আগুন লাগানোর সময়।
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে একটি লাইটার, তুলা এবং দাহ্য পদার্থ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ মনে করছে, এ ধরনের অপরাধের পেছনে ইচ্ছাকৃত উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যদিও বিষয়টি তদন্তাধীন।
আবহাওয়া পরিস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া
জেরুজালেমের অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের কমান্ডার শমুলিক ফ্রিডম্যান জানান, “ইসরায়েলের ইতিহাসে এটা সম্ভবত সবচেয়ে বড় দাবানল।” তিনি আরও বলেন, “ঘণ্টায় ৬০ মাইল বা তার বেশি গতির বাতাস পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।” তিনি বলেন, “আমরা এখনো জানি না আগুন কীভাবে শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট উৎস চিহ্নিত করা যায়নি।”
আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইসরায়েল ইতোমধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে সহায়তা চেয়ে পাঠিয়েছে। এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহায়তার গুরুত্ব অপরিসীম। আগুন যাতে গাজা কিংবা লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকার দিকে না ছড়িয়ে পড়ে, সে দিকেও নজর রাখছে কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে, ইসরায়েলের বন বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে, এই দাবানলের প্রভাব আগামী কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, কারণ উচ্চ তাপমাত্রা এবং বাতাসের গতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
জেরুজালেমের উপকণ্ঠে দাবানল পরিস্থিতি ইসরায়েলের জন্য এক বড় ধরণের দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, রাস্তাঘাট বন্ধ, মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া, এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া—সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি কতটা জটিল।
ইসরায়েলের জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন এই দুর্যোগের পরিণতির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশাসন ও উদ্ধারকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে। এখন দেখার বিষয়—এই ভয়াবহ আগুন কত দ্রুত সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় এবং এর আর্থসামাজিক প্রভাব কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়।