বিশ্ব

সীমান্তে থামছে না গোলাগুলি, উত্তপ্ত এলওসি পরিস্থিতি

দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা আবারও চরমে পৌঁছেছে। জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর টানা সপ্তম দিনের মতো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। বুধবার রাত (৩০ এপ্রিল) কুপওয়ারা, উরি এবং আখনুর সেক্টরে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার (১ মে) এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি বলে দাবি করা হয়েছে।

সীমান্তে উত্তেজনার পটভূমি

চলমান সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে ২৪ এপ্রিল, যখন ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগাম এলাকায় এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা সদস্য এবং বেসামরিক নাগরিকও ছিলেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ওপর দোষ চাপায়।

সেই হামলার পর থেকেই নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর রাতের অন্ধকারে নিয়মিত গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করে গুলি চালায়, যার জবাবে ভারতীয় সেনারা প্রতিরক্ষা মূলক পাল্টা গুলিবর্ষণ করে।

কোন কোন এলাকায় সংঘর্ষ?

সূত্র অনুযায়ী, সর্বশেষ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে জম্মু ও কাশ্মীরের তিনটি প্রধান সীমান্ত সেক্টরে:

  • কুপওয়ারা সেক্টর: উত্তর কাশ্মীরের একটি সেনাবাহিনী-সংবেদনশীল অঞ্চল, যেখানে প্রায়ই অনুপ্রবেশ ও গোপন অস্ত্র পরিবহণের অভিযোগ উঠে।
  • উরি সেক্টর: সীমান্তের অন্যতম স্পর্শকাতর এলাকা, যেখানে অতীতে বহুবার সংঘর্ষ হয়েছে।
  • আখনুর সেক্টর: জম্মু অঞ্চলের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই সেক্টরটিও প্রায়ই সীমান্ত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গুলির শব্দে তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে রাত কাটাচ্ছেন। অনেকেই নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

ভারত ও পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ভারতের অবস্থান:

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, “পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তে যুদ্ধবিরতির নিয়ম ভেঙে ভারী অস্ত্র থেকে গুলি ও মর্টার হামলা চালিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী উপযুক্ত জবাব দিয়েছে।”

ভারতীয় গণমাধ্যম NDTV, The Hindu ও Times of India এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে স্যাটেলাইট ইমেজ ও গোয়েন্দা তথ্য তুলে ধরা হয়।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া:

অন্যদিকে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতর (ISPR) এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ভারতীয় সেনার ‘উসকানিমূলক হামলার’ জবাবে তারা প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের সীমান্ত উত্তেজনায় আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক বলেন:

“আমরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনার গভীর পর্যবেক্ষণ করছি। দুই দেশকেই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছি।”

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, “ভারত-পাকিস্তান উভয় পক্ষকে আমরা সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে আগ্রহী হতে অনুরোধ করছি।”

যুদ্ধবিরতি চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি চুক্তি নবায়ন করেছিল এবং তারপরে কিছু সময়ের জন্য সীমান্তে শান্তি বিরাজ করছিল। কিন্তু পেহেলগাম হামলার পর সেই চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতামত:

ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) অরুণ সাহা বলেন:

“যুদ্ধবিরতির চুক্তি শুধুই কাগজে থাকলে চলবে না। পাকিস্তান যদি সত্যিই শান্তি চায়, তাহলে তাদের মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।”

অন্যদিকে পাকিস্তানি বিশ্লেষক ড. হাসান আসকারি মনে করেন:

“এই গোলাগুলির ঘটনা সীমান্ত অঞ্চলের মানুষকে বিপর্যস্ত করছে। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এই উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা নেই।”

সীমান্তবাসীদের দুর্ভোগ

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ রেখার আশপাশে বসবাসরত সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকেই চাষবাস বা পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, যেটি এখন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।

স্থানীয় প্রশাসন কয়েকটি গ্রামে অস্থায়ী শেল্টার খুলেছে। তবে খাবার, ওষুধ ও নিরাপত্তা সংকটের অভিযোগ রয়েছে।

জম্মুর রাজৌরি জেলার বাসিন্দা গুলাম নবি বলেন:

“প্রতিদিন রাতেই গুলির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। ছোট ছোট বাচ্চারা আতঙ্কে থাকে। আমরা আর শান্তিতে বাঁচতে পারছি না।”

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চলমান গোলাগুলির এই ধারা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় হুমকি। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা শুধুমাত্র দুই দেশ নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলের উচিত এই দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা, যাতে কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button