বিশ্ব

কাশ্মীর হামলায় উত্তেজনা, ইরানের মধ্যস্থতার উদ্যোগ

কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের উত্তেজনা বাড়ছে। হামলার জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে, পাকিস্তান ভারতের বয়ান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে এবং উত্তেজনা প্রশমনে ইরানের মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে।

পেহেলগামে হামলা এবং ভারতের প্রতিক্রিয়া

গত রবিবার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, পেহেলগামের হামলা সন্ত্রাসের মদদদাতাদের কাপুরুষতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, “এই হামলার ছবি দেখে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের রক্ত টগবগ করে উঠেছে। আক্রান্ত পরিবারগুলোর প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে যারা আছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেওয়া হবে।”

ভারতীয় সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এ হামলার পেছনে পাকিস্তান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে এই দাবি পাকিস্তান সরাসরি অস্বীকার করেছে।

পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বলেন, “পেহেলগামের ঘটনায় ভারত যে দাবি করছে, তা সত্য নাকি মিথ্যা—তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা দরকার। চীন, রাশিয়া, এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর অংশগ্রহণে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা উচিত।”

তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান এই অঞ্চলে শান্তি চায় এবং এই ধরনের হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইসলামাবাদ প্রস্তুত রয়েছে স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে।

ইরানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব ও পাকিস্তানের অবস্থান

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীর পরিস্থিতি সামাল দিতে ইরান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফোনালাপে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ইরানের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তান নিজেও গত দুই দশক ধরে সন্ত্রাসবাদে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার পাকিস্তানি সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তাই শান্তির পক্ষে থাকা পাকিস্তান কখনো এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা চায় না।”

শাহবাজ শরিফ আরও জানান, পাকিস্তান পক্ষপাতহীন ও আন্তর্জাতিক মানের তদন্তের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি ও নতুন উত্তেজনা

কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় (LoC) নতুন করে গোলাগুলির খবরও পাওয়া গেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, পাকিস্তান বিনা উসকানিতে গুলি ছুঁড়েছে। জবাবে ভারতীয় সেনারাও পাল্টা গুলি চালিয়েছে। যদিও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পেহেলগামের হামলা এবং নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলির ঘটনা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

সমুদ্রেও শক্তি প্রদর্শন: ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা

কাশ্মীর ইস্যুর উত্তাপের মধ্যেই ভারত তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী আরব সাগরে একাধিক দূরপাল্লার জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। নৌবাহিনীর এক্স পোস্টে বলা হয়, “দূরপাল্লায় নির্ভুল হামলার সক্ষমতা যাচাই ও প্রদর্শনের অংশ হিসেবে প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম ও ক্রুদের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে একাধিক সফল ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে।”

নৌবাহিনী আরও বলেছে, “দেশের সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধের জন্য ভারতীয় নৌবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত।”

বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের সামরিক মহড়া মূলত প্রতিবেশী দেশগুলোকে শক্তির বার্তা পাঠানোর কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগ

দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, কাশ্মীরে নতুন করে সহিংসতা এবং সামরিক প্রদর্শন এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই কাশ্মীর ইস্যুতে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

বিশেষ করে, চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সম্পৃক্ততা এবং ইরানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, তার অনেকটাই নির্ধারণ করতে পারে। তবে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের মাত্রা যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে, যা স্থায়ী সমাধানে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়াতে পারে।

কাশ্মীরের পেহেলগামের হামলা একদিকে যেমন নতুন করে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতাকে সামনে এনেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্বেগ তৈরি করেছে। মোদি সরকারের কড়া প্রতিক্রিয়া ও পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এর মধ্যেই ইরানের মধ্যস্থতার উদ্যোগ সামান্য হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে।

তবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে উভয় পক্ষকেই উত্তেজনা কমাতে সংযত আচরণ করা জরুরি। নয়তো সামান্য একটি হামলার ঘটনা থেকে আবারও বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button