বিশ্ব

শহীদ ঝন্টু আলিকে শেষ শ্রদ্ধা জানালো না বিজেপি

ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনীর সাহসী সদস্য, হাবিলদার ঝন্টু আলি শেখ। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার তেহট্টের বাসিন্দা এই বীর সন্তানের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে তাঁর গ্রামসহ সমগ্র রাজ্যে।

শুক্রবার সকালে তার নিথর দেহ কফিনে মোড়া অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। তাকে শেষবারের মতো দেখতে ভিড় জমে স্থানীয় বাসিন্দা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় ঝন্টু আলি শেখকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। জনতা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তোলে, “হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ”, “ঝন্টু আলি অমর রহে।”

তবে শোকের এই পরিবেশেও তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, শহীদ ঝন্টু আলিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও বিজেপির কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতাকে দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বরা।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার তীব্র প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, “ঝন্টু আলি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এ সময় রাজনীতি নয়, মানবিকতার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিজেপির নেতারা কোথায়?”

একই সুরে কথা বলেছেন সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তীও। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এটা সেই সময়, যখন একত্রিত হয়ে লড়তে হয়। শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তারা আসল জাতীয়তাবাদের মূল্যই বোঝে না।”

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

বিষয়টি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক, এক্স (পূর্বে টুইটার) সহ নানা মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, ‘‘দেশপ্রেমের বড় বড় বুলি তো শোনা যায়, তবে এখন কোথায় সেই নেতৃত্ব?’’ অনেকে আবার লিখেছেন, ‘‘যখন ভোটের দরকার পড়ে তখন শহীদদের নাম ভাঙিয়ে প্রচার চলে, আর সত্যিকারের মুহূর্তে নিরবতা?’’

বিজেপির পাল্টা প্রতিক্রিয়া

রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য এই সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তার দাবি, ‘‘এসব সম্পূর্ণ অপপ্রচার। আমাদের স্থানীয় নেতৃত্ব তেহট্টে গিয়েছিলেন এবং শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এছাড়া দলের শীর্ষ নেতৃত্বও শীঘ্রই পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন।’’

তবে তিনি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেননি ঠিক কোন কোন বিজেপি নেতা ঝন্টু আলির বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। ফলে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

ঝন্টু আলি শেখের জীবন ও সংগ্রাম

ঝন্টু আলি শেখ ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের সদস্য। একাধিকবার সীমান্তে অভিযান চালিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের মতে, ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেম ছিল ঝন্টুর মনে। পড়াশোনার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে যোগদানের স্বপ্ন লালন করতেন।

২০০৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বিভিন্ন অপারেশনে সাহসিকতার জন্য একাধিকবার সম্মানিতও হয়েছিলেন। সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের এক সংঘর্ষে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ হারান তিনি।

ঝন্টুর পিতা আলতাফ শেখ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, এটা আমাদের গর্বের বিষয়। তবে সরকারের কাছে অনুরোধ, শহীদ পরিবারগুলোর পাশে যেন সবসময় থাকে।”

শহীদ পরিবারের দাবী

ঝন্টুর পরিবার ও স্থানীয়রা শহীদ পরিবারদের জন্য সরকারি সহায়তা এবং বিশেষ সুবিধার দাবি তুলেছেন। তাদের কথায়, ‘‘একটা সন্তান হারানোর যন্ত্রণা বলে বোঝানো যায় না। তবে দেশের জন্য যদি কাউকে ত্যাগ করতে হয়, সেটাই গর্বের বিষয়। সরকারের উচিত, শহীদ পরিবারের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো।’’

রাজনৈতিক বার্তা ও ভবিষ্যৎ নির্দেশনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনাটি রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং দেশপ্রেম নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলছে। রাজনীতি যদি মানবিকতা ও সংহতিকে ছাপিয়ে যায়, তবে তা দেশের ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. অরিন্দম সিংহ বলেন, “শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জাতির সম্মান। এখানে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ থাকা উচিত নয়। দলমত নির্বিশেষে সম্মান জানানো প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।”

তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক নেতাদের উচিত দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে শহীদ পরিবারগুলোর পাশে থাকা। কারণ, সেনারাই দেশের শেষ রক্ষাকবচ।”

উপসংহার

ঝন্টু আলি শেখের আত্মত্যাগ আজ গোটা দেশের জন্য গর্বের। তার মৃত্যুতে জাতি একদিকে যেমন শোকাহত, অন্যদিকে রাজনৈতিক মনোমালিন্য বিষয়টিকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।

এই মুহূর্তে দেশের প্রয়োজন ঐক্য ও সংহতি। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও এখন উচিত হবে সমস্ত বিভেদ ভুলে জাতীয় স্বার্থে একজোট হওয়া এবং শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা।

শহীদ ঝন্টু আলি শেখের আত্মা শান্তি পাক—এই প্রার্থনাই আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয় থেকে উচ্চারিত হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button