ইরানের শহীদ রাজয়ি বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ: নিহত ১৪, আহত ৭৫০

ইরানের বন্দর আব্বাস শহরের কাছে অবস্থিত শহীদ রাজয়ি বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৭৫০ জনের বেশি মানুষ। শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইরনা’ এই তথ্য নিশ্চিত করেছে
এই বিস্ফোরণের ঘটনায় ইরানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এখনো আহতদের চিকিৎসা এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছেন দমকল বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীরা। ঘটনার ভয়াবহতার কারণে বন্দর এলাকার আশপাশের জনপদেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
শহীদ রাজয়ি বন্দর: ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র
শহীদ রাজয়ি বন্দর ইরানের অন্যতম ব্যস্ততম এবং আধুনিক কনটেইনার বন্দর। এটি ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে, বন্দর আব্বাস শহরের ২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এই বন্দরটি হরমুজ প্রণালির উত্তরে অবস্থিত, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জলপথ। বিশ্বে সরবরাহকৃত প্রায় এক-পঞ্চমাংশ তেল এই প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত হয়।
বন্দরটি কেবল ইরানের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রই নয়, বরং আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বন্দরে কনটেইনার, তেল এবং বিভিন্ন রকমের শিল্পজাত পণ্য রপ্তানি এবং আমদানি করা হয়।
কীভাবে ঘটল বিস্ফোরণ?
ইরানের সংকট ব্যবস্থাপনা সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন জাফরি জানান, প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, বন্দরে থাকা কিছু কনটেইনারে সংরক্ষিত রাসায়নিক পদার্থের অনিরাপদ মজুতই বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। তিনি স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “কনটেইনারের ভেতরে রাখা রাসায়নিক থেকেই এই বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
হোসেইন জাফরি আরও বলেন, ইতোপূর্বে সংকট ব্যবস্থাপনা সংস্থা কর্তৃপক্ষকে বন্দরের ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক সংরক্ষণের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। কিন্তু সেই সতর্কতার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল।
ইরানের সরকারি মুখপাত্ররাও জানিয়েছেন, রাসায়নিক পদার্থই বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ হলেও, এখনো চূড়ান্ত তদন্তের আগে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযান
বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলে দমকল বাহিনী, জরুরি উদ্ধারকারী দল এবং নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ফুটেজে দেখা যায়, বন্দর এলাকা থেকে ঘন কালো ধোঁয়া উড়ছে। অনেকগুলো কনটেইনার আগুনে জ্বলছে এবং আগুন নেভাতে হেলিকপ্টারের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসকান্দার মোমেনি সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে জানান, “আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। আশপাশের এলাকায় যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি।”
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগছে কারণ বন্দরের কনটেইনারগুলোতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক এবং দাহ্য পদার্থ ছিল, যা দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেয়।
বিস্ফোরণের প্রভাব: বিদ্যালয় ও অফিস বন্ধ
বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আশপাশের অঞ্চলগুলোতেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে, হরমোজগান প্রদেশের রাজধানী শহর বন্দর আব্বাস থেকে বিস্ফোরণের ধোঁয়া দৃশ্যমান হওয়ায় প্রশাসন আজ রবিবার (২৭ এপ্রিল) সেখানকার সব বিদ্যালয় ও অফিস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, সকল জরুরি পরিষেবা সংস্থা যেন দুর্ঘটনা মোকাবেলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারে।
প্রেসিডেন্টের নির্দেশনায় তদন্ত শুরু
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
প্রেসিডেন্টের নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসকান্দার মোমেনি এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তদন্তের জন্য একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যারা বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করবে এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয় সুপারিশ করবে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও সহমর্মিতা
শহীদ রাজয়ি বন্দরের এই বিস্ফোরণের পর আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। হরমুজ প্রণালি বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ রুট হওয়ায়, এই দুর্ঘটনার প্রভাব তেলবাজারেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রতিবেশী দেশ ইরানকে উদ্ধার ও সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে ইরানের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন।
অতীতেও ঘটেছে এমন দুর্ঘটনা
উল্লেখ্য, ইরানে শিল্প এলাকা ও বন্দরগুলোতে অনিরাপদ রাসায়নিক সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে অতীতেও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে তেহরানের পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে বিস্ফোরণে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ফলে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, ইরানে শিল্প ও বন্দর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।
শহীদ রাজয়ি বন্দরের এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ইরানের জন্য একটি বড় ধাক্কা। মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন নজর রয়েছে তদন্তের ফলাফলের দিকে এবং কীভাবে ইরান ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে প্রস্তুতি নেয়, সেটির ওপর।