বানিজ্য

ওয়েস্টার্ন মেরিনের দুই টাগবোট রপ্তানি জুলাইয়ে

Advertisement

চট্টগ্রামভিত্তিক নামকরা জাহাজ নির্মাণ ও রপ্তানি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড চলতি মাসেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের মারওয়ান শিপিং লিমিটেডকে দুইটি টাগবোট সরবরাহ করতে যাচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বোট ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ সময় ক্রেতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

টাগবোট দুইটির রপ্তানি মূল্য ১৫ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বিনিময়হারে প্রায় ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা সমপরিমাণ। এই অর্থবহ রপ্তানি চুক্তি বাংলাদেশের জাহাজ শিল্পের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের মালিকানাধীন টাগবোটের বিশদ বিবরণ

২০২৩ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিন সংযুক্ত আরব আমিরাতের মারওয়ান শিপিং লিমিটেডের সঙ্গে আটটি জাহাজ নির্মাণের চুক্তি সম্পাদন করে। এই আটটি জাহাজের মধ্যে রয়েছে:

  • দুইটি টাগবোট (৬৫ টন ও ৮০ টন বোলার্ড পুল ক্ষমতাসম্পন্ন) — ‘খালিদ’ ও ‘ঘায়া’,
  • চারটি ল্যান্ডিং ক্রাফট,
  • দুইটি ট্যাংকার।

এই দুই টাগবোট চলতি জুলাই মাসেই আমিরাতে রপ্তানি করা হবে। এ ছাড়াও, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৬৯ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘রায়ান’ নামের একটি ল্যান্ডিং ক্রাফট হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি জাহাজ আগামী বছরের মধ্যে সরবরাহ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের জাহাজ রপ্তানির ইতিহাস ও ওয়েস্টার্ন মেরিনের অবদান

বাংলাদেশের জাহাজ রপ্তানির সূচনা হয় ২০০৮ সালে, যখন ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ ডেনমার্কে প্রথমবারের মতো একটি জাহাজ রপ্তানি করে। এরপর ২০১০ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড চট্টগ্রামের শিপইয়ার্ড হিসেবে প্রথমবারের মতো জার্মানিতে একটি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ১১টি দেশে ৩৪টি জাহাজ রপ্তানি করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ভূমিকা অগ্রণী।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের বর্তমান অবস্থা ও শেয়ারবাজারের তথ্য

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক সংকটের কারণে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি, যার ফলে এটি বর্তমানে জেড শ্রেণির কোম্পানির মধ্যে পড়ে।

২০২৫ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল মাত্র ৮ টাকা ৯০ পয়সা। তবে এই রপ্তানি চুক্তি প্রতিষ্ঠানটির জন্য নতুন শক্তি এবং সম্ভাবনার সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাহাজ রপ্তানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান

বাংলাদেশ এখন শুধু পোশাক ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নয়, জাহাজ নির্মাণ ও রপ্তানিতেও নিজের অবস্থান দৃঢ় করছে। এর ফলে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্ববাজারে টাগবোট, ল্যান্ডিং ক্রাফট, ট্যাংকারসহ বিভিন্ন প্রকার জলযান রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পে নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের জাহাজের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চট্টগ্রাম বোট ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লে. জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ বলেন, “ওয়েস্টার্ন মেরিনের এই রপ্তানি বাংলাদেশের সামুদ্রিক শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা প্রমাণ করে দেশের প্রযুক্তি এবং নির্মাণ মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।”

সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স হুমাইদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দারউইশ আলতামিমী ও মারওয়ান শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ আলমারজুকি।

সার্বিক মূল্যায়ন

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের দুইটি টাগবোটের রপ্তানি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিকনির্দেশনা। এটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়, দেশের সমুদ্র শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করবে। এ ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি বাংলাদেশের শিল্প জগতকে আরও স্বাবলম্বী এবং সক্ষম করে তুলবে।

বাংলাদেশ এখন জাহাজ রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে, যা দেশি শ্রমিক ও প্রকৌশলীদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ এনে দিচ্ছে।

কীভাবে বাংলাদেশের জাহাজ রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে?

  • প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার,
  • দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ,
  • আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি,
  • সরকারি সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশ আরও বেশি সংখ্যক সমুদ্রগামী জলযান রপ্তানি করতে সক্ষম হবে।

চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড চলতি জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মারওয়ান শিপিং লিমিটেডের কাছে দুইটি আধুনিক টাগবোট রপ্তানি করতে যাচ্ছে, যার মূল্য প্রায় ১৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে আটটি জাহাজ নির্মাণের চুক্তির অংশ এই দুই টাগবোট, যা বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য গৌরবের বিষয়। এর ফলে দেশের সামুদ্রিক শিল্পের আন্তর্জাতিক অবস্থান মজবুত হবে এবং ভবিষ্যতে আরও রপ্তানি বৃদ্ধির পথ সুগম হবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button