বিশ্ব

পাকিস্তানে বিয়ে হওয়া ভারতীয় নারীরা সীমান্তে আটকা উত্তপ্ত ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক

ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বৈরিতির মাঝে মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র উঠে এসেছে আত্তারি-ওয়াগা সীমান্তে। পাকিস্তানি পুরুষদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ বেশ কয়েকজন ভারতীয় নারী এখন সীমান্তে আটকে পড়েছেন। তাঁদের কাছে বৈধ ভারতীয় পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও ভারতে প্রবেশ বা পাকিস্তানে ফেরার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার এই মানবিক দিকটি এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

কী ঘটেছে আত্তারি-ওয়াগা সীমান্তে?

হিন্দুস্তান টাইমসের বরাতে জানা যায়, শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) কর্মকর্তারা বেশ কয়েকজন ভারতীয় নারীকে পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি দেননি। এ নারীরা তাঁদের পাকিস্তানি স্বামী ও সন্তানদের কাছে ফেরার জন্য সীমান্ত পার হচ্ছিলেন।

ওই নারীদের প্রত্যেকেরই ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে এবং তাদের ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র বৈধ। তারপরও তাঁদের আটকে দেওয়া হয়, যার ফলে সীমান্তে সৃষ্টি হয় চরম মানবিক সংকট।

পেহেলগামের হামলা এবং তার প্রভাব

এই ঘটনার সূত্রপাত মূলত ২২ এপ্রিলের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামের বৈসরান এলাকায় পর্যটকদের ওপর চালানো হামলায় ২৬ জন নিহত হন। হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও ভারতীয় সরকার এর জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকেই দায়ী করছে।

এই ঘটনার পর ভারত সরকার দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। পাকিস্তানিদের ভারত ছেড়ে যেতে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরমধ্যে ২৮৭ জন পাকিস্তানি নাগরিক ভারত ত্যাগ করেন এবং ১৯১ জন ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তান থেকে ভারতে ফিরে আসেন। তবে এই সিদ্ধান্তের আঁচ এসে পড়ে সাধারণ নাগরিকদের ওপরও।

আটকে পড়া নারীদের কণ্ঠে হতাশা

আটকে পড়া ৩৮ বছর বয়সী ওয়াশিন জাহাঙ্গীর জানান, তিনি হাঁপানির চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছিলেন। তাঁর স্বামী ও দুই ছেলে করাচিতে অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন,

“আমার সমস্ত কাগজপত্র বৈধ। পাকিস্তান আমাকে অর্ধেক নাগরিকত্বও দিয়েছে। তবুও আমাকে সীমান্তে আটকে দেওয়া হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, পেহেলগাম হামলার খবর পাওয়ার পর দ্রুত সীমান্তে পৌঁছাতে তিনি ও তাঁর পরিবার প্রায় ১ লাখ রুপি ব্যয় করেছেন। তাঁর প্রশ্ন,

“আমরা তো নিরপরাধ। সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও কেন আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে?”

একই রকম ভোগান্তির কথা বলেন রাজস্থানের যোধপুর থেকে আসা ওয়াজিদা খান। তিনি জানান, দশ বছর আগে পাকিস্তানে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর দুই সন্তান, যাদের বয়স সাত ও আট বছর, বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছে।

“আমাকে আটকে দিয়ে আমার ছোট ছোট সন্তানদের একা ফেরত পাঠানো হয়েছে। এটা কীভাবে মানবিক আচরণ হতে পারে?” — প্রশ্ন তোলেন ওয়াজিদা।

সীমান্ত পরিস্থিতি আরও জটিল

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেবল ভারতীয় নাগরিকদেরই নয়, পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী নারীদেরও ভারতে প্রবেশ করতে দেয়নি। একইভাবে পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী নারীদের ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। ফলে উভয় দেশের সীমান্তে আটকা পড়েছেন বেশ কিছু নারী, যাদের অবস্থান এখন অনিশ্চিত।

এদিকে, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে আসা বহু পাকিস্তানি নাগরিকও সংকটে পড়েছেন। দিল্লির একটি হাসপাতালে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য আসা ফিদা হোসেন বলেন,

“অনেক কষ্ট করে ভিসা পেয়েছিলাম। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা ব্যয় করেছি। এখন এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে সবকিছু বৃথা হয়ে গেল।”

উত্তেজনার পটভূমি

পেহেলগামের হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। দুই দেশের রাজনৈতিক ভাষ্যও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। ভারতের গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তের দুপাশে এখন সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের মাঝে নিরীহ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি একটি বড় মানবিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, যুদ্ধ বা সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে কোনো দেশের সরকার সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করতে পারে না।

ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেরই উচিত—মানবিক বিবেচনায় আটকে পড়া নাগরিকদের নিরাপদে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তা করা।

আত্তারি-ওয়াগা সীমান্তে আটকে পড়া ভারতীয় নারীদের করুণ অবস্থার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—রাজনৈতিক সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ মানুষ। যারা কোনো অপরাধে জড়িত নয়, তবুও তাঁদের জীবনে নেমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়।

বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মানবিকতা রক্ষা করাই এখন সময়ের দাবি। নয়তো দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের আস্থার সংকট আরও গভীর হবে, যার মাশুল দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button