ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন। এই আলোচনাকে ঘিরে তারা শিগগিরই সরাসরি বৈঠক করার পরিকল্পনা করছেন। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু স্থান পাবে বলে জানা গেছে।
রামাফোসা এই মন্তব্য করেন বৃহস্পতিবার, দক্ষিণ আফ্রিকায় সফররত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর। এই সফর ছিল মূলত ইউক্রেনের পক্ষে আফ্রিকার সমর্থন আদায়ের একটি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। তবে কিয়েভে ভয়াবহ রুশ হামলার কারণে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে যান জেলেনস্কি।
ইউক্রেনের কিয়েভে রাত্রিকালীন হামলা
বুধবার দিবাগত রাতে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে চালানো রাশিয়ার একটি বড় ধরনের রকেট ও ড্রোন হামলায় অন্তত নয়জন নিহত হন। এতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনমনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সফর বাতিল করে তাৎক্ষণিকভাবে ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি এক সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘রাত্রিকালীন হামলায় ইউক্রেনের রাজধানীতে অন্তত নয়জন নিহত হয়েছেন। আমি অবিলম্বে ইউক্রেনে ফিরে যাব।’
এই হামলা আবারও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অস্থিরতা ও সহিংসতার মাত্রা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। একইসঙ্গে এটি ইউক্রেনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
শান্তিপ্রক্রিয়া ও রামাফোসা-ট্রাম্প সংলাপ
রামাফোসা জানিয়েছেন, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে একটি গঠনমূলক আলোচনা করেছেন যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত অবসান এবং অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি রোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছেন।
রামাফোসা বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেন শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছি। অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি কমাতে আমরা এই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি। আমরা শিগগিরই বৈঠক করার বিষয়ে একমত হয়েছি। বৈঠকে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করব।’
এই মন্তব্য বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন এক কূটনৈতিক সংলাপের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে আফ্রিকার দেশগুলোকেও বৈশ্বিক শান্তি আলোচনার কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের টানাপোড়েন
তবে এই আলোচনার পেছনে রয়েছে জটিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রেক্ষাপট। ট্রাম্প ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকেই প্রিটোরিয়া এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা গেছে।
বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার যখন গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করে, তখন তা যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ট্রাম্প সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার এই পদক্ষেপসহ অভ্যন্তরীণ নীতিমালারও কড়া সমালোচনা করে।
এর ধারাবাহিকতায় গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
বিতর্কিত মন্তব্য ও সহায়তা বন্ধ
ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আরও কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় তথাকথিত ‘শ্বেতাঙ্গবিরোধী ভূমিনীতি’ চলছে এবং এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে দেশটিকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা বন্ধ করেন।
তাছাড়া তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ‘নির্যাতিত’ শ্বেতাঙ্গদের যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব দেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার মুখে পড়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
রামাফোসার শান্তিপূর্ণ বার্তা
যদিও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ, রামাফোসা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক বার্তা দেন। তিনি লেখেন, ‘আমি ও ট্রাম্প আমাদের দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একমত হয়েছি।’
এই মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ গলানোর একটি প্রয়াস এবং রামাফোসার কূটনৈতিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
আফ্রিকার অবস্থান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফ্রিকান দেশগুলোর ভূমিকাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন করে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো ইস্যুতে আফ্রিকার অবস্থান দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি আঞ্চলিক শক্তির নেতৃত্বে এমন এক সময় আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রচেষ্টা জোরদার করা হলে, তা বিশ্ব রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় ইউক্রেন সংঘাত আজও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুদ্ধের ফলে খাদ্য সংকট, জ্বালানি ঘাটতি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। আফ্রিকান দেশগুলোর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব অনেকটাই দৃশ্যমান, কারণ অনেক দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে।
সম্মেলনের সম্ভাব্য এজেন্ডা
রামাফোসা ও ট্রাম্পের সম্ভাব্য বৈঠকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো স্থান পেতে পারে:
- ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব
- আফ্রিকান দেশগুলোর ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তি
- দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আরোপিত আর্থিক সহায়তা বন্ধের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা
- গাজা ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়
- দক্ষিণ আফ্রিকা-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন