বিশ্ব

সন্ত্রাসী তালিকা থেকে তালেবানকে বাদ দিলো রাশিয়া

আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবানের জন্য রাশিয়া থেকে এলো এক বড় রাজনৈতিক স্বীকৃতি। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়ের নিষেধাজ্ঞা ও বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দিয়েছে রাশিয়া। এই সিদ্ধান্ত দেশটির সুপ্রিম কোর্ট থেকে বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয়। তালেবানের জন্য এটি কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসরে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রাশিয়ার এই পদক্ষেপ তালেবান ও মস্কোর মধ্যে ক্রমশ সুদৃঢ় হতে থাকা কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কেরই আরেকটি দৃশ্যমান প্রকাশ। দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আবদ্ধ তালেবান সরকারের জন্য এই স্বীকৃতি একপ্রকার বৈধতা এনে দিলো। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার লড়াইয়েও এটি হতে পারে বড় সাফল্যের সোপান।


রাশিয়ার আইনে পরিবর্তন এবং তালেবান-সম্পর্কের নতুন মোড়

২০২৩ সালে রাশিয়ার সংসদে পাস হওয়া একটি নতুন আইনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে সংগঠন বাদ দেওয়ার ক্ষমতা আদালতের হাতে দেওয়া হয়। সেই আইনের আওতায় তালেবানকে নিষিদ্ধ সংগঠন তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আনুষ্ঠানিক আবেদন করা হয়। এবং অবশেষে বৃহস্পতিবার কোর্ট এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায় শুধু আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। তালেবান-রাশিয়া সম্পর্কের এই নতুন ধারা মস্কোর মধ্য এশিয়া কৌশলের অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।


সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা: মস্কোর কূটনৈতিক পরিবর্তন

গত কয়েক বছর ধরেই তালেবান এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে। তালেবানের প্রতিনিধিরা একাধিকবার রাশিয়া সফর করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং বৈঠকে তালেবানের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে রাশিয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

২০২১ সালে তালেবানের দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের শাসনভার গ্রহণের পর আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠনটি স্বীকৃতির জন্য যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তার পেছনে রাশিয়ার এই পদক্ষেপ বড় একটি সমর্থন বলেই বিশ্লেষকদের অভিমত। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক রাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকলেও, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোর জন্যও দৃষ্টান্ত হতে পারে।


ইতিহাসের পাতা থেকে: তালেবান-রাশিয়া সম্পর্কের চড়াই-উতরাই

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তালেবান সরকার পতনের পর, ২০০৩ সালে রাশিয়া তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সেই থেকে তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার সব ধরনের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল আইনি অপরাধ। রাশিয়ার আইন অনুযায়ী, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা মানেই ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়া।

এই দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো রাশিয়ার বর্তমান সিদ্ধান্তকে রীতিমতো ঐতিহাসিক বলছেন আফগানিস্তান ও রাশিয়া সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। বিশেষত মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা ও বাণিজ্য কাঠামোতে তালেবানের ভূমিকাকে সামনে রেখে মস্কো এই পরিবর্তন আনছে বলে মনে করা হচ্ছে।


তালেবানের প্রতিক্রিয়া ও কৌশলগত প্রভাব

রাশিয়ার এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে তালেবান। সংগঠনটির মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য কেবল রাজনৈতিক স্বীকৃতিই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মর্যাদার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।’

তালেবান নেতৃত্ব মনে করছে, এই রায়ের মাধ্যমে তাদের উপর থেকে ‘সন্ত্রাসী তকমা’ সরে গেছে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক এবং কূটনৈতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও উন্মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানকে বাদ দেওয়া রাশিয়ার কৌশলের পেছনে শুধু রাজনৈতিক স্বীকৃতি নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণও কাজ করছে। আফগানিস্তানের বিপুল খনিজ সম্পদ, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়াকে সংযুক্ত করা ট্রানজিট বাণিজ্য এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে তালেবানের ঘনিষ্ঠতা রাশিয়ার জন্যও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।


মধ্য এশিয়ায় নতুন শক্তির ভারসাম্য

তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়া একদিকে যেমন তালেবানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চায়, তেমনি পশ্চিমা শক্তির কৌশলগত প্রতিপক্ষ হিসেবেও তালেবানকে ব্যবহার করতে আগ্রহী।

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান দ্রুত ক্ষমতা গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে পশ্চিমাদের সঙ্গে তালেবানের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের অবসান ঘটে। এই শূন্যস্থান পূরণের জন্যই রাশিয়া এবং চীন তালেবানের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক জোরদার করছে বলে মন্তব্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের।


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে ইতোমধ্যে ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে আন্তর্জাতিকভাবে তালেবানের মর্যাদা নিয়ে যে বিতর্ক বিদ্যমান, তা আরও গভীর হতে পারে বলে ধারণা করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। অনেক দেশ তালেবান সরকারের নারী অধিকার, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তাই রাশিয়ার এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বিশ্বমঞ্চে নতুন আলোচনা এবং মেরুকরণের জন্ম দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তালেবানের এই স্বীকৃতি রাশিয়ার জন্য যেমন কৌশলগত বিজয়, তালেবানের জন্যও এটি আন্তর্জাতিক বৈধতার এক ধাপ অগ্রগতি। ভবিষ্যতে এটি আফগানিস্তানের জন্য আরও বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক সাহায্যের পথ প্রশস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে এই সম্পর্ক মস্কোর জন্যও আফগানিস্তানের খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে পা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করছে।


উপসংহার

রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্টের এই রায় শুধু একটি আইনি পদক্ষেপ নয়, বরং মধ্য এশিয়া এবং বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করার ইঙ্গিতবাহী। তালেবান এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত একটি গোষ্ঠী হলেও, রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত তাদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে অনেকটাই শক্তিশালী করবে।

বিশ্ব রাজনীতিতে তালেবানের নতুন পরিচয় এবং রাশিয়ার এই নতুন মিত্রতার প্রভাব ভবিষ্যতে কতদূর বিস্তার লাভ করবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button