বিশ্ব

কাশ্মীরে হামলা, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় ৫ সিদ্ধান্ত মোদির

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ হামলার জেরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ ঘটনায় অন্তত ২৬ জন নিহত হওয়ার পরপরই ২৩ এপ্রিল (বুধবার) দিল্লিতে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে তিনি পাঁচটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

হামলার পেছনে সন্দেহভাজন গোষ্ঠী ও মোদির প্রতিক্রিয়া

এই হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেসিসটেন্স ফোর্স’ (TRF) নামের একটি স্বল্প পরিচিত কাশ্মীরভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেছে, নিহতরা সাধারণ পর্যটক ছিলেন না, বরং তারা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং পর্যটকের ছদ্মবেশে গোপন অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। যদিও এই দাবির সত্যতা সম্পর্কে ভারত সরকার এখনো কোনো মন্তব্য করেনি, তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এ বিষয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “পেহেলগামে কাপুরুষোচিত এই হামলায় আমরা অনেক নিরীহ মানুষকে হারিয়েছি। এটি ভারতের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত। যারা এ হামলার পেছনে রয়েছে, তারা কঠিন জবাব পাবে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান কঠোর এবং আমরা কোনো ছাড় দেব না।”

মোদির গৃহীত পাঁচ সিদ্ধান্ত

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা হচ্ছে:

  1. ইন্দুস পানি চুক্তি বাতিল:
    ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ইন্দুস পানি চুক্তি ছিল দুই দেশের সম্পর্কের একটি মূল ভিত্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান ইন্দুস, ঝেলাম ও চেনাব নদীর পানি ব্যবহার করত। ভারতের পক্ষ থেকে এ চুক্তি বাতিলের অর্থ হলো, পাকিস্তানের পানি সরবরাহে বড় ধরণের বাধা আসতে পারে।
  2. সার্ক ভিসা সুবিধা প্রত্যাহার:
    দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ভুক্তভোগী দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ভিসা সহজীকরণের একটি উদ্যোগ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানিদের জন্য এই সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে ভারত, যা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক পরিবেশে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
  3. আটারি সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা:
    ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের ওয়াঘা সীমান্ত সংলগ্ন আটারি চেকপোস্ট দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত ও বাণিজ্য চলে। এটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
  4. হাই কমিশন কর্মীদের প্রত্যাহার:
    ইসলামাবাদে ভারতের হাই কমিশন থেকে সব কূটনৈতিক ও কর্মী পর্যায়ের সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি পাকিস্তানকেও তাদের কূটনীতিকদের ফিরিয়ে নিতে বলা হয়েছে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে কার্যত বন্ধ করার ইঙ্গিত দেয়।
  5. বর্তমান ভিসা বাতিল ও নাগরিকদের বহিষ্কার:
    বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত সব পাকিস্তানি নাগরিকের ভিসা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি চূড়ান্ত বার্তা যে, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমানে কোনো ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় না।

হামলার তদন্ত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

এই ঘটনায় ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছে। সন্দেহভাজন তিন বন্দুকধারীর স্কেচ ইতোমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে এবং কাশ্মীরজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে পর্যটকদের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে এবং সীমান্ত এলাকাগুলোতে সেনা টহল বাড়ানো হয়েছে।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা হামলার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনবো। এটা শুধু একটা সন্ত্রাসী হামলা নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর এক নির্মম আঘাত। হামলাকারীরা যতই শক্তিশালী হোক, তাদের ধরা হবে এবং উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর ভারত আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সমর্থন চাইছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদদানের অভিযোগ তুলে ধরতে সক্রিয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই হামলার নিন্দা জানিয়ে ভারতকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

এদিকে, পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছে এবং একে ভারতের “ভিত্তিহীন অভিযোগ” বলে আখ্যা দিয়েছে। ইসলামাবাদ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “ভারত সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যর্থতা ঢাকতে পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে।”

বিশ্লেষকদের মত

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলো দীর্ঘমেয়াদে উপমহাদেশের কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে ইন্দুস পানি চুক্তি বাতিল ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার ঝুঁকি বাড়াবে।

দিল্লিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. অনীতা কুমার বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো একদিকে যেমন ভারতের কড়াকড়ি নীতির প্রতিফলন, অন্যদিকে এটি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য হুমকিস্বরূপও হতে পারে। ভবিষ্যতে এই সংকট আরও গভীর হলে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button