বিশ্ব

ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত, হামলা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ দেশ ইয়েমেনে আবারও উত্তেজনা বেড়েছে। দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ড্রোনটি ইয়েমেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হাজ্জাহ প্রদেশে হামলা চালানোর সময় সেটিকে গুলি করে নামানো হয় বলে জানিয়েছেন হুতি মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি।

এটি চলতি মাসে হুতিদের হাতে ধ্বংস হওয়া সপ্তম মার্কিন ড্রোন, আর ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত হুতিদের দাবি অনুযায়ী ২২তম ড্রোন।

যুক্তরাষ্ট্রের টানা হামলা: তিন প্রদেশে একাধিক বিমান হামলা

হুতি নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম আল মাসিরাহ জানায়, গতকাল মঙ্গলবার রাতেই লোহিত সাগরের কামরান দ্বীপ, পশ্চিম ইয়েমেনের আল সালিফ, এবং উত্তরাঞ্চলের সা’দা প্রদেশের আল সালিম এলাকায় অন্তত নয়টি বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এসব হামলার লক্ষ্য ছিল হুতিদের সামরিক ঘাঁটি ও অস্ত্রগার।

এই হামলা চলমান থাকার মধ্যে হুতিরা নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনাটি সামনে এনেছে।

শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দমন অভিযান’

হুতিরা ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ইসরায়েলের মিত্র বলে দাবি করা ১০০টিরও বেশি বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে। এসব হামলা মূলত লোহিত সাগর ও বাব আল-মান্দেব প্রণালীতে ঘটে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ।

মার্কিন প্রশাসন স্পষ্ট করে দিয়েছে,

“যতদিন না হুতিরা জাহাজে হামলা বন্ধ করছে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান চলবে।”

হুতিদের দাবি, তারা গাজার জনগণের প্রতি সংহতি জানাতে এসব হামলা করছে এবং বলেছে,

“ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত হুতি আক্রমণ বন্ধ করবে না।”

অব্যাহত হামলায় নিহত ২০০+, বহু নারী-শিশু হতাহত

যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত বিমান হামলায় ইতিমধ্যেই ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • হোদেইদা বন্দর ও বিমানবন্দরে ১৩টি বিমান হামলা (গত সপ্তাহে)
  • রাস ইসা বন্দরে হামলায় ৮০ জন নিহত, ১৫০ জন আহত (তিন সপ্তাহ আগে)
  • সানা শহরের এক আবাসিক এলাকায় হামলায় ১২ জন নিহত (দুদিন আগে)

এসব ঘটনার ফলে হুতিরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে জনমত উস্কে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের মত।

সুয়েজ খালে বিশৃঙ্খলা: বিকল্প পথে যাচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য

হুতিদের হামলার কারণে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সুয়েজ খাল ভিত্তিক আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলে, যেখানে বিশ্বের প্রায় ১২% বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে।

অসংখ্য কোম্পানি বাধ্য হয়েছে ব্যয়বহুল বিকল্প পথে, অর্থাৎ কেপ অব গুড হোপ ঘুরে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাতায়াত করতে। এতে বাণিজ্যিক খরচ বেড়েছে, পণ্য পরিবহনে সময় লাগছে দ্বিগুণ, এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে।

গাজা যুদ্ধ ও হুতিদের ভূমিকা: আঞ্চলিক জটিলতার শিকড়

হুতিরা ইরানের সমর্থিত একটি শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় এক দশক ধরে যুদ্ধ করে আসছে। তবে ২০২৩ সালের শেষভাগে গাজায় ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের সময় তারা নিজেদের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে পরিবর্তন করে। গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে হুতিরা নিজেদের ‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’-এর অংশ হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে।

তাদের যুক্তি:

“ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে গেলে আমরা বিশ্ববাণিজ্যের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে হলেও ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকব।”

এই অবস্থান আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে হুতিদের প্রোফাইল বাড়ালেও, এর মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের আরও বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

হুতিদের প্রতিরোধ নাকি নতুন যুদ্ধের সূচনা?

বিশ্লেষকরা বলছেন, হুতিদের ড্রোন গুলি করে নামানোর ক্ষমতা আগের চেয়ে বেশি হয়েছে। এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন সাধারণত উচ্চ প্রযুক্তির এবং রাডার এড়িয়ে চলার সক্ষমতা রাখে। এ ধরনের ড্রোন ভূপাতিত করতে পারা হুতিদের সামরিক দক্ষতার উন্নতির ইঙ্গিত দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি উদ্বেগের কারণ। কারণ, ইয়েমেনে সেনা মোতায়েন না করেও কেবল ড্রোন ও বিমান হামলার মাধ্যমে হুতিদের দমন করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞ মত: “এ যুদ্ধ আর কেবল ইয়েমেনের নয়”

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. রামি খালেদ বলেন,

“গাজা যুদ্ধের ছায়া এখন ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়াতেও পড়েছে। এই সংঘাত আর একদেশে সীমাবদ্ধ নয়।”

তিনি আরও বলেন,

“হুতিদের মাধ্যমে ইরান যেমন আঞ্চলিক চাপ সৃষ্টি করছে, যুক্তরাষ্ট্রও তার প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় হয়েছে। এর ফলে পুরো অঞ্চলজুড়ে ‘প্রক্সি যুদ্ধের’ এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।”

উত্তপ্ত ইয়েমেন, অচল লোহিত সাগর

হুতিদের ড্রোন গুলি করে নামানোর দাবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলার বাস্তবতায় ইয়েমেন আরও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে যাচ্ছে। আর এই সংঘাত সরাসরি প্রভাব ফেলছে বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহন, তেল সরবরাহ, ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে

গাজায় যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই হুতিদের হামলা বেড়ে যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জবাব আরও আগ্রাসী হবে—এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button