বিশ্ব

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে সৌদি আরবকে আহ্বান ট্রাম্পের

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবকে ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এ যোগদানের জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৩ মে) রিয়াদে অনুষ্ঠিত সৌদি-মার্কিন বিনিয়োগ ফোরামে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি এই আবেদন জানান। 1 ট্রাম্পের মতে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং অঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক পোস্টের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিয়াদ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প সরাসরি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে লক্ষ্য করে বলেন, “এটি সৌদি আরবের জন্য বিশাল সম্মানের এবং অঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তার এই বক্তব্য এমন এক সময়ে এলো যখন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাত পুরো অঞ্চলকে নতুন করে উত্তপ্ত করে তুলেছে।

আব্রাহাম অ্যাকর্ডস হলো ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি চুক্তি। ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালে এই চুক্তির সূচনা হয়েছিল। এর আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কো ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক অচলাবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে এবং ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের মধ্যে নতুন এক সম্পর্কের দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যদিও ফিলিস্তিনিরা এটিকে আরব বিশ্বের পক্ষ থেকে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রতি পিঠটান হিসেবে দেখে।

সৌদি আরব এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেনি। তবে গত কয়েক বছরে উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু গোপন বৈঠকের খবর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব বৈঠকে নিরাপত্তা সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ইস্যুতে আলোচনার কথা জানা যায়। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি ফিলিস্তিন সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অথবা ফিলিস্তিনিদের জন্য উল্লেখযোগ্য ছাড় ছাড়া সৌদি আরব এই পথে হাঁটতে রাজি নয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গাজায় চলমান যুদ্ধ ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনাকে কার্যত স্থবির করে দিয়েছে। সৌদি আরব যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনিদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন সৌদি আরবের জন্য অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনমত এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে, গাজার পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবের পক্ষে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন।

তবে ট্রাম্পের এই সফর এবং তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে তার কূটনৈতিক ভূমিকা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী। বিশেষ করে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসকে তিনি তার প্রশাসনের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক নীতির সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চান। রিয়াদে দেওয়া ভাষণে তিনি বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনা করে দাবি করেন যে, তার সরকারের সময়ে শুরু হওয়া এই শান্তি প্রক্রিয়া বাইডেন প্রশাসন সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে পারেনি। ট্রাম্পের এই দাবি বাইডেন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রতি এক প্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই উদ্যোগ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে তার বৈদেশিক নীতির সাফল্যগুলো পুনরায় সামনে আনার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। তিনি ভোটারদের কাছে প্রমাণ করতে চান যে, তার নেতৃত্বেই মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্ভব হয়েছিল। সৌদি আরবকে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলে তা নিঃসন্দেহে একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে, যা ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করতে পারবেন। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী আরব দেশ হওয়ায় এর স্বীকৃতি পেলে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের গুরুত্ব এবং বৈধতা আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে।

রিয়াদের বিনিয়োগ ফোরামে ট্রাম্পের উপস্থিতি এবং তার এই জোরালো আহ্বান সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা উসকে দিয়েছে। যদিও গাজার যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি প্রতিকূল, তবুও দীর্ঘমেয়াদে এই সম্পর্ক স্থাপন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এই আহ্বানে তাৎক্ষণিক আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে পর্দার আড়ালে আলোচনা যে অব্যাহত থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, তেমনই অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। সৌদি আরব কি ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ছাড় আদায় না করেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে? নাকি গাজার পরিস্থিতি শান্ত হওয়া এবং ফিলিস্তিন সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য অপেক্ষা করবে? ভবিষ্যৎই এর উত্তর দেবে।

এই মুহূর্তে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের পথে প্রধান বাধা গাজার যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন বিষয়ক অমীমাংসিত প্রশ্ন। সৌদি আরব সবসময়ই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ওপর জোর দিয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের জন্য কী ধরনের ছাড় দেওয়া হবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি নিয়েও সৌদি আরবের কিছু দাবি রয়েছে, যা তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিনিময়ে আদায় করতে আগ্রহী।

ট্রাম্পের এই আহ্বান এমন এক সময়ে এলো যখন বাইডেন প্রশাসনও সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও তারা এটিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু প্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। ট্রাম্পের কৌশল হয়তো এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা অথবা বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে নিজেকে এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর প্রমাণ করা। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে সৌদি আরবের নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতির ওপর। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন একটি বহুমাত্রিক এবং জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ জড়িত। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের ভবিষ্যৎ বিস্তার এবং সৌদি আরবের এতে অন্তর্ভুক্তি এই প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আগামী দিনগুলোতে আরও আলোচনার জন্ম দেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button