বিশ্ব

ইস্টার সানডে উপলক্ষ্যে ইউক্রেনে সাময়িক যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা পুতিনের

ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে এবার মানবিকতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। খ্রিস্টানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘ইস্টার সানডে’ উপলক্ষে ইউক্রেনের মাটিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন ক্রেমলিন প্রধান। শনিবার (১৯ এপ্রিল) স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রোববার দিবাগত রাত পর্যন্ত এই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

মস্কোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইস্টার উপলক্ষে ‘মানবিক সহানুভূতি’ থেকেই এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। তবে এই যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে ইউক্রেনকেও সমানভাবে শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন পুতিন। তাঁর ভাষায়, “ধর্মীয় উৎসবের এই সময়ে উভয় পক্ষের উচিত অস্ত্র থামিয়ে নিরীহ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই মানবিক বিরতি কেবল রুশ বাহিনীর পক্ষ থেকে নয়, ইউক্রেনীয় সেনাদেরও সম্মিলিতভাবে অনুসরণ করা উচিত।”

কূটনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

পুতিনের এই একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। মানবিকতার ছোঁয়ায় সিদ্ধান্তটি প্রশংসিত হলেও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এর পেছনে রয়েছে কৌশলগত চিন্তা। যুদ্ধের মোড় পরিবর্তনের পরিকল্পনা, বিশ্ব জনমত প্রভাবিত করা কিংবা মার্কিন রাজনীতিতে সাম্প্রতিক আলোড়নকেও সামনে রেখে এই ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।

বিশেষ করে সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত রাজনীতিবিদ ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মধ্যস্থতার প্রস্তাব থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন, তার ঠিক পরেই আসে পুতিনের এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। ফলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একে নিছক মানবিক পদক্ষেপের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক বার্তা বলেই মনে করছেন।

ইউক্রেনের নীরবতা

এদিকে পুতিনের এই ঘোষণার বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। যদিও ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়ার ঘোষণাকে ‘প্রপাগান্ডা’ হিসেবে দেখছে কিয়েভ। ইউক্রেনের একাধিক সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, রুশ বাহিনী এর আগেও একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে অনেকবারই ইউক্রেনীয় সেনাদের ফাঁদে ফেলেছে। তাই কিয়েভ এই ঘোষণা কতটা আন্তরিক তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেন, “রাশিয়া যুদ্ধের সময়বার বার এ ধরনের একতরফা বিরতির কথা বলেছে, তবে বাস্তবে সেগুলো কৌশলগত পুনর্গঠন এবং সেনা সরণির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ইউক্রেন এই ধরণের ঘোষণা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে।”

যুদ্ধের বাস্তবতা ও মানবিক সংকট

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ দু’দেশের জনগণকেই অসহনীয় দুর্ভোগের মুখে ফেলেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে প্রায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। প্রতিনিয়ত নিহত হচ্ছেন অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক, ধ্বংস হচ্ছে অবকাঠামো, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং খাদ্য সরবরাহের চেইন।

ইস্টার সানডে উপলক্ষে যুদ্ধবিরতি যদি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, তবে কিছু সময়ের জন্য হলেও নাগরিকদের স্বস্তি মিলবে, এমনটাই আশা করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। আন্তর্জাতিক রেডক্রস (আইসিআরসি) ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধবিরতিকে ‘অন্তত কিছুক্ষণের জন্য মানবিক দমবন্ধ অবস্থার উপশম’ বলে স্বাগত জানিয়েছে।

মার্কিন চাপ এবং ট্রাম্পের ভূমিকা

এই যুদ্ধবিরতির পটভূমিতে মার্কিন রাজনীতির প্রভাবও অনস্বীকার্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ার পরই শান্তি উদ্যোগ থেকে খানিকটা সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর পুতিনের যুদ্ধবিরতির বার্তা কেবল ইউক্রেন নয়, গোটা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি বার্তা বহন করে বলেই মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সহায়তার প্রবাহ এবং অস্ত্র সরবরাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে। ট্রাম্পের নিষ্ক্রিয়তা রাশিয়ার পক্ষে পরিস্থিতিকে কিছুটা সহজ করে তুলতে পারে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই পুতিন কৌশলী যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে বিশ্ব জনমতের কাছে ‘মানবিক’ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টায় রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।

পুতিনের কূটনৈতিক অবস্থান

বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ভ্লাদিমির পুতিন বরাবরই কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত। যুদ্ধের শুরু থেকে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনার মধ্যেও তিনি কখনোই আপোষ করেননি। বরং ইউক্রেনকে ‘নাটসির আস্তানা’ বলে অভিহিত করে মস্কো শুরু থেকেই যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধ, পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক চাপের মুখে রাশিয়া কিছুটা কৌশল পরিবর্তন করছে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

এই যুদ্ধবিরতির মধ্যেও পুতিন কোনো স্থায়ী সমাধানের ইঙ্গিত দেননি। বরং মানবিকতার দোহাই দিয়ে যুদ্ধের সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে আবারো ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজ দেশের অবস্থানকে নরম ভাবমূর্তিতে উপস্থাপন করতে চাইছেন বলেই মত কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনো পুতিনের এই ঘোষণার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বড় মন্তব্য করেনি। তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, “এই ধরনের যুদ্ধবিরতি যদি আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে তা অসহায় নাগরিকদের জন্য কিছুটা হলেও মুক্তির সুযোগ তৈরি করবে। তবে যুদ্ধের মূল সমাধান কেবল সংলাপ ও কূটনৈতিক আলোচনা।”

অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও ইস্টার সানডের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে উভয় পক্ষের আন্তরিকতা প্রয়োজন। যুদ্ধবিরতি তাৎক্ষণিক স্বস্তি দিলেও, স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।”

উপসংহার

ইউক্রেনে ইস্টার সানডে উপলক্ষে রাশিয়ার ঘোষিত এই যুদ্ধবিরতি নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করে। তবে এটি স্থায়ী শান্তির পথে কতটা এগিয়ে নেবে, তা সময়ই বলে দেবে। যুদ্ধবিরতির আড়ালে কূটনৈতিক হিসাব নিকাশ আর সামরিক কৌশলের যে খেলা চলছে, তাতে বিশ্ববাসীর চোখ এখনো ইউক্রেনের যুদ্ধভূমির দিকেই নিবদ্ধ।

মানবিকতার মোড়কে মোড়া এই যুদ্ধবিরতি শুধুই কি শান্তির ইঙ্গিত, নাকি যুদ্ধের নতুন কৌশল—এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুব শিগগিরই পাওয়া যাবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button