ওয়াক্ফ আইনকে ঘিরে উত্তাল মুর্শিদাবাদ: ২০০ গ্রেপ্তার, নিহত ৩

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে বিতর্কিত ওয়াক্ফ (সংশোধনী) আইন ঘিরে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩ জন এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ২০০ জন। এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গুজব ও সহিংসতা ঠেকাতে প্রশাসন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধসহ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেছে।
কী এই ওয়াক্ফ (সংশোধনী) আইন?
ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার সম্প্রতি ওয়াক্ফ (সংশোধনী) আইন পাস করে, যাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওয়াক্ফ সম্পত্তির ব্যবহার ও তদারকি নিয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয়। সমালোচকদের মতে, এই আইন মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি ও তাদের ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে খর্ব করে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও বীরভূমের মতো মুসলিমপ্রধান জেলাগুলোতে এই আইনকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে।
সহিংসতার সূত্রপাত ও নিহতের ঘটনা
গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া সহিংসতা রোববার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান, সুতি ও সামশেরগঞ্জ এলাকায় সহিংসতা সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বিক্ষোভরত জনতা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে পুলিশ গুলি চালায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছেন।
২০০ জন গ্রেপ্তার, মোতায়েন কেন্দ্রীয় বাহিনী
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) জাভেদ শামীম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, “ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ২০০–এর বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মুর্শিদাবাদে মোতায়েন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ১৫ কোম্পানি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও বাহিনী পাঠানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সহিংসতা রোধে প্রতিটি গ্রামে টহল জোরদার করা হয়েছে।
গুজব রুখতে ইন্টারনেট বন্ধ, সীমান্তে উত্তেজনা
গুজবের মাধ্যমে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে—এই আশঙ্কায় মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং বীরভূমের সীমান্ত এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে যৌথ বাহিনী মাইকিং করে জানিয়ে দিচ্ছে, “গুজবে কান দেবেন না। কেউ আইন হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গঙ্গা পেরিয়ে আশ্রয়ে মালদহে
সহিংসতা এড়াতে মুর্শিদাবাদ থেকে বহু মানুষ গঙ্গা পেরিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মালদহ জেলার বৈষ্ণবনগরে। রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের জন্য খাবার ও থাকার অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ যেন এক মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র, যেখানে রাজনৈতিক বিতর্কের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
তৃণমূলের এমপি ইউসুফ পাঠানের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ
মুর্শিদাবাদের তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ইউসুফ পাঠানের ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সহিংসতা শুরু হলেও তাঁকে এলাকায় দেখা না যাওয়ায় অনেকেই অভিযোগ করছেন, তিনি জনগণের পাশে নেই। যদিও তিনি এই বিষয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতি দেননি।
বিজেপির বিক্ষোভ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি
সহিংসতার দায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর চাপিয়ে পদত্যাগ দাবি করেছে বিজেপি। রবিবার কলকাতার কলেজ স্কয়ারে বিক্ষোভ মিছিল করে দলটি। পরে বিক্ষোভ ধর্মতলায় গিয়ে শেষ হয়। বিজেপির দাবি, রাজ্যের পুলিশ যদি সক্রিয় থাকত, তাহলে এই সহিংসতা এড়ানো যেত।
বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, “এই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। অথচ তিনি ব্যর্থ হয়েছেন সহিংসতা থামাতে।”
বিজেপির সংসদ সদস্য জগন্নাথ সরকার এই পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদসহ সাতটি জেলায় সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (AFSPA) জারির দাবি তুলেছেন।
শিক্ষক ছাঁটাইয়ের ইস্যুও গরম
ওয়াক্ফ আইন ইস্যুর পাশাপাশি রাজ্যে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের ঘটনায় আরও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। চাকরিচ্যুতদের সংগঠন ‘যোগ্য শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী ঐক্য মঞ্চ’ দিল্লির যন্তরমন্তরে অবস্থান ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিয়েছে। তাঁরা বাসে করে দিল্লি যাওয়ার পথে বিভিন্ন রাজ্যে প্রচারপত্র বিলি করবেন এবং রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করবেন।
তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ: ‘বাংলাকে অশান্ত করার চেষ্টা’
তৃণমূলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, বিজেপি পরিকল্পিতভাবে বাংলাকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “রাজ্যের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হচ্ছে, আমরা বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছি।”
পুলিশ প্রশাসনের হুঁশিয়ারি
রাজ্য পুলিশের আইজি রাজীব কুমার রাজ্যবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “কোনো রকম গুন্ডাবাজিকে বরদাশত করা হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
উত্তপ্ত রাজনীতির মাঝখানে সাধারণ মানুষ
ওয়াক্ফ আইনকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই সহিংসতা রাজনীতির এক জটিল ধাঁধার পরিণতি। এখানে যেমন রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত আইন, তেমনি রয়েছে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কূটকৌশল। অথচ প্রতিবারের মতোই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তির পথ কঠিন। ভবিষ্যতের জন্য এই ঘটনা যেন শিক্ষা হয়—রাজনীতি নয়, অগ্রাধিকার হোক শান্তি ও জননিরাপত্তা।