বিশ্ব

গাজার হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল

গাজার একটি প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র আল আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী—এমন অভিযোগ করেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। হামলায় হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) এবং সার্জারি বিভাগ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজ-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

আগুন ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হাসপাতাল এলাকা

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পর হাসপাতালের দুইতলা ভবন থেকে প্রচণ্ড আগুন এবং ধোঁয়া উঠছে। ভেতরে থাকা রোগী, অভিভাবক এবং হাসপাতাল কর্মীদের আতঙ্কে ছুটে পালাতে দেখা যায়। অনেকেই আহত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছিলেন, অনেকে হাসপাতালের বিছানাসহ বের হওয়ার চেষ্টা করেন।

আইসিইউ এবং সার্জারি ইউনিট ধ্বংস

স্থানীয় সূত্রের বরাতে বিবিসি জানায়, হামলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে হাসপাতালের আইসিইউ এবং সার্জারি ইউনিটে। সেখানে থাকা আশঙ্কাজনক ও গুরুতর রোগীদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে, যদিও অনেককে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও বহু মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “এই হামলা শুধু একটি হাসপাতাল ধ্বংস করেনি, এটি পুরো গাজা অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আমরা জরুরি ভিত্তিতে রোগীদের স্থানান্তর করছি, তবে সুষ্ঠু চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব।”

চিকিৎসা সংকটে বিধ্বস্ত গাজা

ইতিমধ্যেই গাজা উপত্যকায় চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ ও চিকিৎসাকর্মীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চলমান সংঘাতের কারণে অধিকাংশ হাসপাতাল হয় ক্ষতিগ্রস্ত, নয়তো বিদ্যুৎ ও পানি সংকটে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আল আহলি হাসপাতালের মতো একটি কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সমগ্র গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার পথে।

হামাসের অভিযোগ

হামাস এক বিবৃতিতে জানায়, “ইসরায়েল এই হামলার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ করেছে। অসুস্থ, আহত এবং চিকিৎসাধীন নিরীহ মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে লঙ্ঘন করেছে। এটি চূড়ান্ত বর্বরতা।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিন্দা জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, “চিকিৎসা কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের শামিল। এর তদন্ত হওয়া জরুরি।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এই ঘটনার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, “গাজায় সুশৃঙ্খল ও কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা রক্ষা করা অপরিহার্য। যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে নিরস্ত্র মানুষদের উপর হামলা চলতে পারে না।”

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইসরায়েলি সরকার বা সেনাবাহিনী (আইডিএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে আল আহলি হাসপাতাল হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ইসরায়েল প্রায়শ হাসপাতাল বা স্কুল ভবনে হামলার পর দাবি করে থাকে—সেসব স্থাপনা হামাস বা ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর অস্ত্র গুদাম বা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

আল আহলি হাসপাতালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আল আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতাল গাজার অন্যতম পুরনো ও গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি হাসপাতাল। এটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পরিচালনায় পরিচালিত হয়ে আসছে এবং বহু বছর ধরে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই হাসপাতালের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি বরাবরই ছিল। অতীতেও এটি ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য হয়েছে, তবে এবারকার ক্ষয়ক্ষতি নজিরবিহীন।

সংঘাত আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা

বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই হামলার ফলে ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত আরও তীব্র রূপ নিতে পারে। হাসপাতালে হামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দার ঝড় তুলতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও উত্তেজনা বাড়তে পারে। ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে অবস্থান নিয়েছে।

চিকিৎসা কেন্দ্রের মতো মানবিক স্থানে হামলা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের এই নতুন মাত্রা রীতিমতো উদ্বেগজনক। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোরালো প্রতিবাদ, বিশ্ব নেতাদের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া এই ঘটনার জবাবদিহি নিশ্চিত করা অসম্ভব। একদিকে গাজার মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ, অন্যদিকে বিশ্ব বিবেকের নীরবতা—এই সমীকরণ দীর্ঘমেয়াদে মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নেবে, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button