বিশ্ব

বন্ডের সুদহার বাড়ায় নতি স্বীকার ট্রাম্পের: বিশ্ববাজারে স্বস্তির হাওয়া

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর শুল্কনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি হলেও এক সপ্তাহ অনড় থাকার পর অবশেষে তিনি নরম সুরে ফিরে এসেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে সরকারি বন্ডের সুদহার আকস্মিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সেই চাপে ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য নতুন শুল্ক কার্যকরের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।

শুল্কের হুমকি ও বাজারের প্রতিক্রিয়া

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছিল বিভিন্ন দেশের ওপর একতরফাভাবে পাল্টা শুল্ক চাপানোর ঘোষণায়। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ে, বিনিয়োগকারীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় এবং শেয়ারবাজারে ব্যাপক পতন দেখা দেয়। ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন, “সমস্যা হলে ওষুধ দিতে হয়। ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ওষুধ কাজ শুরু করেছে।”

কিন্তু মার্কিন অর্থনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছিল, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে এই “ওষুধ” কার্যকর হচ্ছে না। বরং, ট্রাম্পের কড়া অবস্থানেই বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক বাড়ছিল।

বন্ড বাজারে বিপদ সংকেত

বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়াটা ছিল একটি বড় সংকেত। সাধারণত অনিশ্চয়তার সময় মানুষ শেয়ারবাজার ছেড়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বন্ড কেনে, ফলে বন্ডের সুদহার কমে যায়। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখা গেছে—বন্ডের সুদহার বেড়ে ৪.৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। এর মানে বিনিয়োগকারীরা বন্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এবং মার্কিন অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।

বন্ড বিক্রির চাপে ফেডারেল রিজার্ভ এবং নীতিনির্ধারকরা চিন্তায় পড়ে যান। এমনকি এক পর্যায়ে ৫০ বিলিয়ন ডলারের সরকারি বন্ড বিক্রির নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়, যা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ‘দেউলিয়া’ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যেত।

অবশেষে শুল্ক স্থগিতের সিদ্ধান্ত

এই চাপেই শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প ৭৫টিরও বেশি দেশের জন্য ‘পারস্পরিক শুল্ক’ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ চারটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। যদিও শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়নি, তবুও বাজারে স্বস্তির বার্তা পৌঁছায়।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “ভাবলাম, মানুষ একটু বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। সবাই একটু বেশি অস্থির হয়ে উঠেছিল, তাই এ সিদ্ধান্ত।”

বিশ্ববাজারে স্বস্তির প্রতিক্রিয়া

এই ঘোষণার পরই এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও শুল্ক-পাল্টা শুল্ক আরোপের অবস্থান থেকে সরে আসে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং শীর্ষ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তারা একইসঙ্গে সতর্ক করেছেন যে পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

বিশেষ করে চীনের পণ্যের ওপর যেসব শুল্ক বলবৎ আছে, তা এখনো তুলে নেওয়া হয়নি। আর এশিয়ার অনেক দেশের অর্থনীতি চীনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত হওয়ায় ওই অঞ্চলে বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে সময় লাগতে পারে।

চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাব

চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বৃহত্তম রপ্তানিকারক ও জ্বালানি আমদানিকারক দেশ। ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে চীনের রপ্তানি ব্যাহত হলে, বাংলাদেশের মতো দেশ—যা সরাসরি কিংবা চীনের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের অংশ—তাদের ওপরও এর প্রভাব পড়ে।

চীনের অর্থনীতির গতি কমে গেলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়ে যেতে পারে। এতে জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর কিছুটা স্বস্তি এলেও সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বিনিয়োগে ধীর গতি এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি

বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পেডেন অ্যান্ড রাইগেলের প্রধান অর্থনীতিবিদ জেফরি ক্লিভল্যান্ড বলেন, “এই অনিশ্চয়তার ফলে আগামী তিন মাস বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগে ধীর গতি দেখা দেবে। যদিও মন্দার শঙ্কা কমেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “এই অস্থির পরিবেশে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে এবং বিনিয়োগকারীরা বেশি মুনাফা আশা করতে পারেন। বন্ড বাজার এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, এবং আগামীতে সুদের হার আরও বাড়তে পারে।”

রাজনৈতিক শোডাউনের পেছনের কৌশল?

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ট্রাম্প এই পুরো শুল্ক নাটকটি নিজের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করার জন্যই সাজিয়েছিলেন। কারণ, ৭৫টিরও বেশি দেশের প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক আলোচনায় তিনি যেন নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।

এমনকি রাতে ট্রুথ সোশ্যাল-এ দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, “দারুণ একটা দিন গেল। আরও দারুণ দিন আসছে।”

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন যে সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে, তা কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। কারণ:

  • চীনের সঙ্গে মূল দ্বন্দ্ব এখনো চলছে
  • মূল শুল্ক অনেক ক্ষেত্রে বলবৎ রয়েছে
  • বন্ড বাজার এখনো অস্থির
  • মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ছে
  • বিনিয়োগকারীরা এখনো দ্বিধান্বিত

বিশ্ব অর্থনীতিকে এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত করতে হলে ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত হবে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল বাণিজ্যনীতি গ্রহণ এবং কূটনৈতিক আলোচনা জোরদার করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button