বিশ্ব

ভারতে ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় উত্তাল কলকাতা

সম্প্রতি ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত ও রাষ্ট্রপতির সম্মতিপ্রাপ্ত ‘ইউনিফায়েড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট’ নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। এই আইনের বিরুদ্ধে সবথেকে সরব হয়ে উঠেছে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়, যারা একে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থবিরোধী বলে আখ্যায়িত করছেন। তারই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) কলকাতার রামলীলা ময়দানে বিশাল সমাবেশ করে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, যেখানে অংশ নেয় লাখো মানুষ।

কলকাতা পরিণত হয় মিছিলের শহরে

বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই কলকাতার রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। পার্ক সার্কাস, মৌলালি, ধর্মতলা, লেনিন সরণি, মা ফ্লাইওভার, এজেসি বোস রোডসহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। সমাবেশস্থল রামলীলা ময়দানের দিকে অগ্রসর হওয়া মানুষের স্রোতের কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়ে শহরের দৈনন্দিন গতি। অফিসগামী মানুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, রোগী পরিবহনসহ সব স্তরের নাগরিককে চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়।

জমিয়তের রাজ্য সভাপতি সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে আয়োজিত এই সমাবেশে যোগ দিতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ রওনা দেন কলকাতার দিকে। অনেকেই পায়ে হেঁটে, ট্রেন বা বাসে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান সমাবেশস্থলে। ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে জমিয়তের এই সমাবেশ শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিবাদ নয়, বরং ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে একটি শক্তিশালী বার্তা হয়ে ওঠে।

ওয়াকফ আইন নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা

সমাবেশে বক্তারা জানান, নতুন ওয়াকফ আইন সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিকভাবে অর্জিত ওয়াকফ সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপের একটি প্রচেষ্টা। এটি বাস্তবায়িত হলে বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, দরগাহসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সরাসরি সরকারের আওতায় চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বক্তাদের মতে, সংবিধানে প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার এই আইনের মাধ্যমে খর্ব হচ্ছে।

সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “এই আইন মুসলিম সমাজের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেবে। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। যতদিন না আইনটি প্রত্যাহার হচ্ছে, ততদিন আমাদের প্রতিবাদ চলবে।”

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ওয়াকফ আইন সংশোধনীর বিরুদ্ধে শুধু জমিয়ত নয়, ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটিও সরব হয়েছে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম), কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি (আপ) ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)-এর নেতারা ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে এই বিলের বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করেছেন। তাদের বক্তব্য, এই আইন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপন্থী।

এছাড়া অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। গুজরাট, মণিপুর, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু সহ একাধিক রাজ্যে ইতিমধ্যে বিক্ষোভ ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংগঠিত প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

পশ্চিমবঙ্গেও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে

সমাবেশের আগেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। মঙ্গলবার বিকেল থেকে মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, মালদা ও বীরভূমে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এর জেরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ ও সুতি থানা এলাকায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS) অনুযায়ী ১৬৩ ধারা (পূর্বের ১৪৪ ধারা) জারি করা হয় এবং ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িক বন্ধ রাখা হয় যাতে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো না যায়।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোর নজরদারি চালানো হচ্ছে। তবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে প্রশাসনের কোনো বাধা নেই। আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর আইনে পরিণত

উল্লেখ্য, এই সংশোধনী বিলটি গত সপ্তাহে ভারতের পার্লামেন্টে উত্তপ্ত বিতর্কের মধ্য দিয়ে পাস হয় এবং ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু অনুমোদন দেওয়ার পর এটি আইনে পরিণত হয়। সরকার পক্ষের দাবি, এই আইন ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনবে এবং দুর্নীতির পথ রুদ্ধ করবে। তবে বিরোধীদের মতে, এটি সংখ্যালঘুদের আত্মনির্ভরতা ও ধর্মীয় অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত।

সমাবেশে উঠে আসা বার্তা

সমাবেশের মঞ্চ থেকে বক্তারা সরকারের কাছে স্পষ্ট বার্তা দেন—অবিলম্বে ওয়াকফ আইন সংশোধনী প্রত্যাহার না হলে আগামী দিনগুলোতে আন্দোলন আরও তীব্র ও বিস্তৃত হবে। জমিয়তের নেতারা বলেন, “আমরা রক্ত দিয়ে এই জমি ও সম্পত্তি রক্ষা করেছি, আজ কোনো আইন দিয়ে তা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হলে তা প্রতিহত করা হবে।”

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক অংশগ্রহণে এই প্রতিবাদ আরও জোরালো রূপ নিয়েছে। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন একত্র হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button