ইরানের পারমাণবিক সমস্যার সমাধানে সবকিছু করতে প্রস্তুত রাশিয়া: ক্রেমলিন

রাশিয়া আবারও তাদের কূটনৈতিক প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে জানিয়েছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্ভূত সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সম্ভাব্য সবধরনের প্রচেষ্টা চালাতে প্রস্তুত। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোমবার (৭ এপ্রিল) এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা জানান। তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে নিয়মিত পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা হচ্ছে এবং রাশিয়া এই ইস্যুর সমাধানে প্রয়োজনীয় সকল কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত।
দিমিত্রি পেসকভের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এল, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি পুনরায় কার্যকর করার সম্ভাবনা অনেকটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। ইরান একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞা এবং হুমকির কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে।
পারমাণবিক আলোচনার পটভূমি
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইরান সম্মিলিতভাবে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়—যা “জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন” (JCPOA) নামে পরিচিত। চুক্তির আওতায় ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করবে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের জন্য পারমাণবিক স্থাপনাগুলো উন্মুক্ত রাখবে। এর পরিবর্তে, তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে।
এই চুক্তি কার্যকর হলে বিশ্বে পারমাণবিক অস্থিরতা হ্রাস পেয়েছিল এবং মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিকে ‘ব্যর্থ ও একতরফা’ আখ্যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে তা থেকে প্রত্যাহার করেন এবং ইরানের ওপর পুনরায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এতে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
নতুন করে উত্তেজনার ঝুঁকি
২০২৫ সালে আবারও প্রেসিডেন্ট পদে ফিরেই ট্রাম্প তার পূর্বের নীতি অনুসরণ করে ইরানকে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ কৌশলের মুখোমুখি করেন। তিনি ইরানকে উদ্দেশ করে বলেন, যদি তারা নতুন কোনো চুক্তিতে সম্মত না হয়, তাহলে এর ফল হবে ‘ভয়াবহ বোমাবর্ষণ’। ট্রাম্পের এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার ঝড় তোলে এবং একে মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির হুমকি হিসেবে দেখা হয়।
ইরান এই হুমকির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আগ্রাসী কৌশলের জবাবে তারা কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। তেহরান আরও জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় যাবে না এবং নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
রাশিয়ার মধ্যস্থতামূলক ভূমিকা
এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার বক্তব্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “আমরা আমাদের ইরানি অংশীদারদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করছি এবং এই ইস্যুতে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। রাশিয়া রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদ্ধতিতে এই সংকট সমাধানে সম্ভাব্য সবকিছু করবে।”
রাশিয়া শুরু থেকেই JCPOA চুক্তির একজন সক্রিয় অংশীদার এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে আসছে। মস্কো মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে ইরানকে কূটনৈতিক পদ্ধতিতে আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত রাখা জরুরি।
কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা কতটুকু?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার এই উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে একই সঙ্গে তারা এও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আগ্রাসী নীতি থেকে সরে না আসে এবং চীনের ভূরাজনৈতিক ভূমিকা বৃদ্ধি না পায়, তবে একটি টেকসই সমাধান অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে।
ইরান বর্তমানে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা আশঙ্কা করছেন। ইরানের দাবি, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এই দাবিতে আস্থা রাখতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ার এই ঘোষণার পর জাতিসংঘের একাধিক সদস্য রাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও চুক্তি পুনরায় কার্যকর করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে এমন এক সময়ে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান সংকট এবং বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তখন ইরান ইস্যুতে একটি সামরিক উত্তেজনা পুরো বিশ্বকেই আরও অস্থির করে তুলতে পারে।
উপসংহার
রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যদি নতুন করে আলোচনার দরজা খুলে যায়, তবে তা হবে কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় সাফল্য। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ইউরোপ এবং অন্যান্য অংশীদারদের সমন্বিত আন্তরিকতা ও বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
দেখা যাক, ভবিষ্যতে এই সংকট কোন পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায়—এই ইস্যু শুধু ইরান বা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।