বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হ্রাসে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করছে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রে আরোপিত শুল্কের ভার লাঘব করতে এবার বড় কূটনৈতিক তৎপরতায় নেমেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি চিঠির খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট মার্কিন পণ্যে শুল্কছাড়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগামী তিন মাসের জন্য বিদ্যমান শুল্ক আরোপ স্থগিত রাখার আহ্বান জানানো হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে।

শুল্ক কমাতে আমদানি খাতে ছাড়ের প্রস্তাব

বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশ এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে ৫০ শতাংশ শুল্কছাড়ের প্রস্তাব বিবেচনা করছে। পাশাপাশি যেসব মার্কিন পণ্যে আগে থেকেই শুল্কছাড় রয়েছে, সেগুলোর জন্য সেই সুবিধা অব্যাহত রাখার কথা ভাবছে সরকার।

বাণিজ্য উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ করপোরেশনগুলোর জন্য (যেমন: ওয়ালমার্ট, শেভরন, মেটা, টেসলা, বোয়িং) বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

বিডার বিশেষ বৈঠক ও সিদ্ধান্ত

গত শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চিঠি পাঠানো হবে এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন।

চিঠিতে শুল্ক ছাড় পাওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিযোগ্য চারটি সম্ভাব্য পণ্যের নামও উল্লেখ করা হয়েছে—ক্যালসিয়াম কার্বনেট, হিমায়িত পশুর মৃতদেহ, হাড়সহ বা হাড়বিহীন তাজা মাংস।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ২ এপ্রিল ঘোষণা করে, বিশ্বের সব দেশের পণ্যে কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হবে, যা কার্যকর হবে ৯ এপ্রিল থেকে। বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক হার পৌঁছেছে ৩৭ শতাংশে। তবে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার পথ এখনো খোলা রেখেছে বলে জানায়।

অশুল্ক বাধা সরানোর উদ্যোগ

শুধু শুল্ক নয়, অশুল্ক বাধাও সরাতে উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত কটন ও সুতা থেকে ফিউমিগেশন শর্ত বাতিল, আমদানিকৃত সুতা গুদামজাত করার অনুমতি, কৃষি ও প্রযুক্তিপণ্য কেনায় অগ্রাধিকার ইত্যাদি।

পূর্বপ্রস্তুতির অভাব ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্বেগ

বিডার বৈঠকে উপস্থিত এক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাংলাদেশে কারখানাগুলোর ওপর এখনই চাপ আসতে শুরু করেছে। শুল্কভার সরবরাহকারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে আমদানিকারকরা। এ অবস্থায় আমাদের পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কম থাকায় শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও ভারত অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে তেমন প্রস্তুতি দেখা যায়নি।’

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার নিয়ে মতভেদ

বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের গড় শুল্কহার ছিল ৬.১৫ শতাংশ। তবে ব্যবসায়ীরা অগ্রিম কর ও ভ্যাট সমন্বয় করে থাকায় প্রকৃত শুল্কহার ২.২০ শতাংশে দাঁড়ায়। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মতে, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এ হিসাব নির্ধারণে শুল্ক ছাড়াও মুদ্রাবিনিময় হার, অশুল্ক বাধা ও বাণিজ্যনীতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্টজনেরা

বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক, এলজিএফইএবির সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, প্রাণ-আরএফএল চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি শামীম এহসান। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান, পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার এবং সানেম নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

নতুন শুল্ক নীতির জটিল বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনায় বাংলাদেশ কতটা সফল হয়, তা নির্ভর করছে সরকার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সমন্বিত পদক্ষেপের ওপর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button