বিশ্ব

গাজায় ১৫ চিকিৎসাকর্মী হত্যার ভিডিও প্রকাশ: ইসরায়েলের বর্ণনার সঙ্গে মিল নেই

রাতের আঁধারে চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্সে হামলা, নিহত ১৫ উদ্ধারকর্মী

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক হামলার নতুন ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পেয়েছে, যা নিয়ে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। ২৩ মার্চ ২০২৫ তারিখে এই হামলায় ১৫ জন উদ্ধারকর্মী—যার মধ্যে প্যারামেডিক, অগ্নিনির্বাপক এবং জাতিসংঘের এক কর্মী ছিলেন—নিহত হন।

এই ভিডিওটি প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (PRCS) প্রকাশ করেছে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও তা প্রদর্শিত হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, স্পষ্টভাবে চিহ্নিত এবং জরুরি বাতি জ্বালানো অ্যাম্বুলেন্স ও রেসকিউ যানবাহনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়।

ভিডিওতে কী দেখা গেছে?

  • ঘটনাস্থল ছিল রাতের আঁধারে আলোকিত রাস্তায় চলমান উদ্ধারযান
  • অ্যাম্বুলেন্স ও ট্রাকগুলোর হেডলাইট এবং জরুরি সংকেত বাতি স্পষ্টভাবে জ্বলছিল
  • গুলির শব্দ কয়েক মিনিট ধরে শোনা যায়, এমনকি ভিডিও ধারণকারী গাড়ির জানালাও গুলিতে ভেঙে যায়।
  • দুই উদ্ধারকর্মীকে আলোক প্রতিফলিত পোশাক পরে গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়, গুলি শুরু হওয়ার আগেই।
  • ভিডিওটি উদ্ধার করা হয় নিহত এক প্যারামেডিকের মোবাইল ফোন থেকে, যিনি ভিডিও ধারণ করছিলেন।

ইসরায়েলের বক্তব্য ও বিতর্ক

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) শুরুতে দাবি করেছিল, তারা চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্সে গুলি চালায়নি এবং যানগুলোর জরুরি বাতি জ্বালানো ছিল না। কিন্তু ফুটেজ প্রকাশের পর তারা বিবিসিকে জানিয়েছে, পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হবে।

তবে ইসরায়েল এখনো তাদের অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে আসেনি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার বলেন, “IDF এলোপাতাড়ি কোনো অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করেনি।” কিন্তু প্রকাশিত ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য তার বিপরীত চিত্র তুলে ধরছে।

বেঁচে যাওয়া প্যারামেডিকের বর্ণনা

ঘটনাটি থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান মুন্থার আবেদ নামের এক প্যারামেডিক। তিনি বিবিসিকে বলেন:

“দিন হোক বা রাত, আমাদের অ্যাম্বুলেন্স সবসময় আলো জ্বালানো থাকে। আপনি একনজরে বুঝবেন—এগুলো চিকিৎসাসেবা দিতে আসা যানবাহন। সেই রাতেও সব আলো জ্বলছিল, তারপরই শুরু হয় গুলি।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা কেউই কোনো সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নই। আমরা শুধুই সাধারণ মানুষ—জীবন রক্ষার জন্য কাজ করছিলাম।”

নিহতদের পরিচয় ও দাফনপ্রক্রিয়ার জটিলতা

  • ৮ জন প্যারামেডিক,
  • ৬ জন গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মী,
  • ১ জন জাতিসংঘ কর্মী—এই ১৫ জনের মরদেহ উদ্ধার হয় বিধ্বস্ত যানগুলোর পাশে বালুচাপা অবস্থায়।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েক দিনের আলোচনা শেষে হামলার পর এক সপ্তাহ পর মরদেহগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

জাতিসংঘ ও মানবিক সংস্থার প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি ইউনিস আল-খতিব বলেন:

“ভিডিওতে নিহত এক প্যারামেডিকের কণ্ঠ আমরা শুনেছি—শেষ মুহূর্তে তিনি বলেন, ‘মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি শুধু মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।’ এটি আমাদের হৃদয় বিদারক করে তোলে।”

তিনি ঘটনাটিকে ‘নৃশংস অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এর নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

ইসরায়েলের দাবির জবাবে প্রশ্ন

ইসরায়েলের দাবি, সেখানে হামাস বা ইসলামিক জিহাদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তারা এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এমনকি যানগুলোর আরোহীরা কোনোভাবে ইসরায়েলি সেনাদের জন্য হুমকি ছিলেন কিনা, সে বিষয়েও ব্যাখ্যা দেয়নি।

প্রকাশিত এই ভিডিও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বাহিনীর মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে হামলার অভিযোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চিহ্নিত চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত উদ্ধারযান ও কর্মীদের ওপর এভাবে হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এই ঘটনায় যেসব প্রশ্ন উঠেছে—তা শুধু ইসরায়েলের দায় নয়, বরং গোটা বিশ্বের মানবিকতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলে ধরে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button