ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় এক ভয়াবহ মানবিক সংকট বিরাজ করছে। জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি (World Food Programme – WFP) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় প্রতি তিনজনের একজন মানুষ অনাহারে দিন পার করছেন। খাদ্যসংকট ও অপুষ্টির কারণে শিশুসহ হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে অপুষ্টিতে মারা গেছেন আরও নয়জন। গাজায় ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষের পর থেকে অপুষ্টিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২২ জনে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ৯০ হাজারের বেশি নারী ও শিশুকে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।
গাজার অবরুদ্ধ অবস্থা এবং খাদ্য সরবরাহে বাধা
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজায় সব ধরনের পণ্যের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে। খাদ্য ও ওষুধসহ সকল প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহে শুল্ক, সীমান্ত ও বিমানবন্দর বন্ধ থাকার ফলে লাখো মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা ত্রাণ প্রবেশে কোনো বাধা দিচ্ছে না, বরং হামাসকেই দায়ী করছে গাজার মানবিক সংকটের জন্য।
অপরদিকে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বলছে, অবরোধের কারণে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশেষত, গাজার বুকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এবং ত্রাণ পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ
সম্প্রতি ইসরায়েলের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শীঘ্রই গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলা হতে পারে। তবে, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো এই পদ্ধতিকে কার্যকর মনে করছে না। কারণ, উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলা হলেও তা সরাসরি দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জর্ডানও গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু, জর্ডানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা এখনও ইসরায়েল থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি পাননি।
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিবাদ ও মানবিক আহ্বান
জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ বহু পশ্চিমা দেশই ইসরায়েলের উপর ত্রাণ প্রবেশের অবিলম্বে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। এ দেশগুলো গাজায় চলমান মানবিক সংকট ও যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। তারা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলারও নির্দেশ দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের কণ্ঠে মানবতার আহ্বান
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক বিপর্যয়ের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদাসীনতা নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, “মানবতার কোনও জায়গা নেই এই সংকটে। সত্যিকার অর্থে কোনও করুণা, মানবতা বা ন্যায়ের অনুপস্থিতি এখানে স্পষ্ট।”
গুতেরেস আরও জানান, ২৭ মে থেকে ত্রাণ সরবরাহের চেষ্টা করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানো ব্যাপক সংকটে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি ও কূটনৈতিক আলোচনার অনিশ্চয়তা
গাজার চলমান যুদ্ধবিরতি ও বন্দিদের মুক্তি নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন কোনো চুক্তির সম্ভাবনা এখন অনিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কাতার থেকে মধ্যস্থতাকারী দল প্রত্যাহার করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “হামাস আসলে কোনো চুক্তি করতে চায় না, তারা মরতেও রাজি।”
তবে হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, আলোচনাগুলো এখনও ভেস্তে যায়নি এবং আগামী সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল দোহায় ফেরার কথা রয়েছে।
২০২৩ সালের সংঘর্ষ থেকে আজ পর্যন্ত: গাজার ভয়াবহ মানবাধিকার পরিস্থিতি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। এই সংঘর্ষে প্রায় ১,২০০ জন ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়। এরপর থেকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ৫৯,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ত্রাণ ও চিকিৎসার অভাবে বহু মানুষ অনাহারে মৃত্যুর মুখে।
গাজার মানবিক সংকট: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয়
গাজার এই মানবিক সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় ও সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য করছে। ত্রাণ পৌঁছানো, অবরোধ শিথিলকরণ এবং দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনার তাগিদ বারবার দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার সংকল্প ব্যক্ত করেছে।
তবে বাস্তবে আন্তর্জাতিক চাপ ও উদ্যোগ কবে গাজার মানুষের মুখে খাদ্যের কুড়ি ঢেলে দিতে পারে, তা এখনও অনিশ্চিত। গাজার প্রতি দৃষ্টিপাত ছাড়া, বিশ্ব মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দুষ্কর হয়ে উঠছে।
গাজার এই সংকট কেবল একটি অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি মানবতার সঙ্কট। প্রতি তিন জনের একজন না খেয়ে দিন পার করার মতো পরিস্থিতি মানবাধিকারের বড় ধরনের লঙ্ঘন। খাদ্যের অভাবে নারী ও শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত গাজার মানুষের দুর্দশা চলতেই থাকবে। আন্তর্জাতিক সমাজের দ্রুত সক্রিয় হবার এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আনার প্রয়োজন অত্যন্ত তীব্র।



