বিশ্ব

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমার, তবু থামেনি জান্তা বাহিনীর বিমান হামলা

শক্তিশালী ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমারে মৃতের সংখ্যা ১,৬০০ ছাড়িয়েছে। দেশজুড়ে ধ্বংসস্তূপের স্তূপ জমেছে, ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবুও, এই দুর্যোগের মাঝেও সামরিক জান্তা বাহিনী বিরোধী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দার সম্মুখীন হয়েছে।​

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা

শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মিয়ানমার কেঁপে ওঠে। এর কেন্দ্রস্থল ছিল উত্তর-পশ্চিমের সাগাইং অঞ্চল। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মান্দালয়, যেখানে বহু ভবন ধসে পড়েছে, রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, এবং হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। দেশটির সামরিক সরকার জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১,৬৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৩,৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। ​

জরুরি অবস্থা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা

ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারের ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সামরিক সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে চীন, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ত্রাণ ও উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছে। জাতিসংঘও জরুরি সাড়া হিসেবে ৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। ​

জান্তা বাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত

দুর্যোগের মাঝেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী বিরোধী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্পের তিন ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে, শুক্রবার বিকেলে উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের নাউংচোতে বিমান হামলায় সাতজন নিহত হয়েছে। এছাড়াও, সাগাইং অঞ্চলের চ্যাং-ইউ শহর এবং থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোতেও হামলার খবর পাওয়া গেছে।​

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুস এই হামলাগুলোকে “জঘন্য এবং অগ্রহণযোগ্য” বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “ভূমিকম্পের পর যখন মানুষ উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তখনো সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে—এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।” তিনি মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে অবিলম্বে সব ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ​

জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রতিক্রিয়া

মিয়ানমারের উৎখাত হওয়া বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী দ্য ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের সশস্ত্র বাহিনী ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে দুই সপ্তাহের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ রাখবে, তবে আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা

উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তবে, অবকাঠামোগত ক্ষতি, যেমন ধসে পড়া সেতু, ভাঙা রাস্তাঘাট, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়, উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমকে কঠিন করে তুলেছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ক্ষতি এবং বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।​

জনসাধারণের অবস্থা

ভূমিকম্পের পর হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে বা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। অনেকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে, যেখানে খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা সেবার অভাব রয়েছে। মান্দালয়ের বাসিন্দা মেই লিন বলেন, “আমাদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা জানি না কীভাবে আবার শুরু করব।”​

ভবিষ্যৎ করণীয়

এই দুর্যোগের পর মিয়ানমারের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগবে এবং এর জন্য স্থায়ী আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। এছাড়াও, মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সামরিক ও রাজনৈতিক সংঘাতের প্রভাব কমাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়ানো উচিত।​

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটময়। ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি সামরিক সংঘাতের অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত সহায়তা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা মিয়ানমারের জনগণের জন্য আশার আলো হতে পারে।​

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button