লোহিত সাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি, মার্কিন রণতরিতে হুতিদের হামলা

ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী আল জাজিরায় একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে দাবি করেছে, তারা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান-এ হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনায় লোহিত সাগরের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, এবং এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর এক নতুন প্রভাব ফেলতে পারে।
হুতিদের হামলা এবং প্রতিক্রিয়া
ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠীর মুখপাত্র জানান, হুতির যোদ্ধারা মার্কিন রণতরিতে হামলা চালিয়েছে, যা এক নতুন ধাপ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান একটি বিশাল যুদ্ধজাহাজ, যা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয় এবং এর বিরুদ্ধে হামলা ইঙ্গিত দেয় যে, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী এখন আরও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে।
হুতি মুখপাত্র আরও জানিয়েছেন যে, মার্কিন আগ্রাসনের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে উত্তেজনা বৃদ্ধি করব, এবং আমাদের প্রতিরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখব,” তিনি বলেন। এটি প্রমাণ করে যে, হুতিরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান সংঘর্ষের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা
মুখপাত্র দাবি করেছেন, হুতি বাহিনী ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের একাধিক সামরিক স্থাপনায় ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এদিকে, হুতিরা জানান যে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বিরোধ অব্যাহত রাখা, বিশেষত গাজা অঞ্চলে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত।
ইসরায়েলি নৌযানের বিরুদ্ধে অবরোধ
হুতি গোষ্ঠী আরও দাবি করেছে যে, তারা ইয়েমেনের কৌশলগত জলসীমায় ইসরায়েলি নৌযান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে থাকবে। এর উদ্দেশ্য হলো, যত দিন না পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ না হবে এবং গাজার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া না হবে, তত দিন পর্যন্ত তারা এই অভিযান চালিয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা এবং ইয়েমেনের পরিস্থিতি
এই ঘটনার পর, মার্কিন সামরিক বাহিনী হুতিদের বিরুদ্ধে আরও বড় ধরনের হামলা শুরু করেছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইয়েমেনের রাজধানী সানা এবং আশপাশের এলাকায় হামলা চালাতে শুরু করে। হুতি-সংশ্লিষ্ট টেলিভিশন চ্যানেল আল মাসিরাহ জানায় যে, সাদা প্রদেশের আল সালেম এলাকায় অন্তত ১৭ বার বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এর ফলে ইয়েমেনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে এবং এটি আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করছে।
ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়
যুদ্ধের এই উত্তেজনা ইয়েমেনের সাধারণ জনগণের জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বেড়ে যাওয়ায় মানবিক সহায়তা সংকট আরও গভীর হচ্ছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কর্মীরা সতর্ক করেছেন যে, যদি এ ধরনের হামলা অব্যাহত থাকে, তবে দেশটির মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র হবে।
বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই উত্তেজনা
এদিকে, এই হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে, বিশেষ করে গাজা ও ইয়েমেনের পরিস্থিতি অনেকটা একে অপরের সঙ্গে জড়িত হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন এবং হুতিদের প্রতিক্রিয়া, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বিরোধের মধ্যে সোজাসুজি সম্পর্ক তৈরি করছে।
বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এই উত্তেজনা আগামী মাসগুলোতে আরও বাড়তে পারে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন, আরব বিশ্ব এবং ইরানের নীতিগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতি আগামী দিনে বৃহৎ রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে।
হুতির পূর্ববর্তী কার্যক্রম
হুতি গোষ্ঠী বহু বছর ধরে ইয়েমেনের যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করার পর থেকেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে এক সৌদি-আরব দেশগুলোর জোট হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে। এই দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে ইয়েমেনের জনগণ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
হুতিরা বলছে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ইয়েমেনের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং বিদেশি আগ্রাসন প্রতিহত করা। তবে তাদের এই দাবির সমর্থকরা খুব কম। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই হুতির কার্যক্রমকে সামরিক আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
সামরিক উত্তেজনার ভবিষ্যত
এখন প্রশ্ন উঠছে যে, এই সামরিক উত্তেজনা কতটা বাড়বে এবং এর প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। হুতি গোষ্ঠী একদিকে যেমন তাদের কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে চলতে থাকবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলোও তাদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারে। এর ফলে, আগামী দিনে আরও বেশি দেশ এই সংঘর্ষে জড়াতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই উত্তেজনা কমানো এবং মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করা। বিশেষত, ইয়েমেনের জনগণের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
মার্কিন রণতরিতে হুতিদের হামলা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের ড্রোন হামলার ঘটনা লোহিত সাগরে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং শান্তির পথে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটি ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।
তবে, বর্তমানে ইয়েমেনের মানুষের জন্য শান্তির কোনো আশা নেই, কারণ তাদের যুদ্ধে মারাত্মক পরিণতি অব্যাহত রয়েছে।