তাইওয়ানের কাছে সামরিক মহড়া বিচ্ছিন্নতাবাদের শাস্তি: চীন

তাইওয়ানের কাছে সোমবার বিশাল সামরিক মহড়া চালিয়েছে চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট লাই ছিং-তের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই মহড়া পরিচালিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বেইজিং। চীনের কঠোর ভাষার বিবৃতিতে এটি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের শাস্তি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। চীন সবসময়ই স্বায়ত্তশাসিত তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে দ্বীপটি দখলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি। অন্যদিকে, তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন স্বীকৃতির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চীন সোমবার সকাল ও বিকালে দুটি যৌথ যুদ্ধ প্রস্তুতি টহল পরিচালনা করেছে। এই মহড়ায় ৫৪টি চীনা যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন তাইওয়ানের কাছ দিয়ে উড়েছে। যুদ্ধবিমানগুলো উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পূর্ব আকাশসীমা পার করে গেছে। এর মধ্যে ৪২টি যুদ্ধবিমান তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখা অতিক্রম করেছে, যা দুই পক্ষের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক বাফার জোন হিসেবে বিবেচিত হয়। তাইওয়ান এই মহড়ার পর্যবেক্ষণে নিজেদের বিমান ও নৌবাহিনী মোতায়েন করেছিল।
চীনের এই সামরিক পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে তাইওয়ানের ‘মেইনল্যান্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল’ বলেছে, বেইজিং দ্বীপটির বিরুদ্ধে অব্যাহত সামরিক হুমকি প্রদর্শন করছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘প্রকৃত সমস্যা সৃষ্টিকারী’ উল্লেখ করে মিত্র দেশগুলোকে চীনের সামরিক সম্প্রসারণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
চীনের কঠোর হুঁশিয়ারি
চীনের তাইওয়ান বিষয়ক দপ্তরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, “লাই প্রশাসন যদি উসকানি দেয় এবং আগুন নিয়ে খেলার সাহস দেখায় তবে এটি কেবল তাদের ধ্বংসই ডেকে আনবে।”
সাধারণত, চীন তার সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কে প্রকাশ্যে খুব বেশি মন্তব্য করে না। তবে এবার সরাসরি তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বেইজিং। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি চীনের পক্ষ থেকে একটি কৌশলগত বার্তা, যা পশ্চিমা বিশ্ব ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রচেষ্টায় চীনের প্রতিক্রিয়া
চীনের সরকার দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানের স্বাধীনতার যে কোনো প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে দমন করার কথা বলে আসছে। তারা মনে করে, তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লাই ছিং-তে চীনের সঙ্গে সংঘাতের পথ বেছে নিচ্ছেন এবং এই কারণে সামরিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন বিশ্বাস করে, তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদ কেবল তাদের স্বার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি নয়, বরং এটি পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এদিকে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীন দ্বীপটির আশপাশে নিয়মিত সামরিক মহড়া চালানোর চেষ্টা করছে এবং প্রায় প্রতি ৭-১০ দিন পরপর টহল দিচ্ছে। এটি তাইওয়ানের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
চীনের সামরিক তৎপরতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এর আগে চীনের সামরিক কার্যকলাপকে ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং তাইওয়ানের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের আত্মরক্ষার জন্য বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ অব্যাহত রাখছে, যা চীনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, চীনের এই কার্যক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশও সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। তারা মনে করছে, চীন যদি তাইওয়ানের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয় তবে পুরো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।
চীন-তাইওয়ান সংকটের ভবিষ্যৎ দিক
বিশ্লেষকদের মতে, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা দ্রুত মীমাংসার কোনো সম্ভাবনা নেই। বেইজিং তার সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়াবে এবং তাইওয়ানও তার আত্মরক্ষার কৌশল জোরদার করবে। প্রেসিডেন্ট লাই বারবার চীনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও, বেইজিং তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
প্রেসিডেন্ট লাই স্পষ্ট করে বলেছেন যে, শুধুমাত্র তাইওয়ানের জনগণই তাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তবে চীন এই অবস্থানকে কখনোই মেনে নেবে না। এর ফলে তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
উপসংহার
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা আবারও চরমে উঠেছে। চীনের সামরিক মহড়া ও কঠোর বিবৃতি ইঙ্গিত দেয় যে, তারা ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি একটি বড় উদ্বেগের বিষয়, কারণ এই সংকট শুধুমাত্র চীন ও তাইওয়ানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি পুরো অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারে। আগামী দিনে এই উত্তেজনা কোন দিকে মোড় নেয়, তা বিশ্ব রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে।