ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদ থেকে এক বাংলাদেশি কিশোরীকে উদ্ধার করেছে স্থানীয় পুলিশ। কিশোরীটি কয়েক মাস আগে দালাল চক্রের প্রলোভনে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছিল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তেলেঙ্গানা টুডে জানিয়েছে, এ ঘটনায় আন্তঃদেশীয় মানব পাচার চক্রের ভয়াবহ দিক আবারও সামনে এসেছে।
❖ প্রথম নয়, বরং দীর্ঘদিনের সমস্যা
এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদ, মুম্বাই, দিল্লি বা কলকাতায় এর আগেও বহুবার বাংলাদেশি নারী ও কিশোরীদের যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। খাইরতাবাদ, বান্দলাগুডা, চাদেরঘাটের মতো এলাকাগুলোতে কয়েক দশক ধরেই এ ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে।
২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও উজবেকিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে নারী পাচারের ঘটনা ঘটেছে। একেবারে সংঘবদ্ধ মাফিয়া চক্র এ সমস্ত নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে।
❖ কীভাবে পাচার হয় বাংলাদেশি নারীরা?
তেলেঙ্গানার এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান—
বাংলাদেশ থেকে পাচারের ক্ষেত্রে সীমান্ত অঞ্চলের দালালরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন সময়ে গরিব ও অসহায় পরিবারগুলোর কিশোরী ও তরুণীদের কাছে পৌঁছে মিথ্যা প্রলোভন দেখায়। কখনো চাকরির আশ্বাস, কখনো বিয়ের প্রলোভন কিংবা ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে মেয়েদের ভারতে পাঠানো হয়।
পাচারকারীরা সাধারণত সীমান্তের স্থলপথ বা নৌপথ ব্যবহার করে। দালালদের সহায়তায় অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করার পর পাচারের শিকার মেয়েদের জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে হায়দরাবাদ, মুম্বাই কিংবা দিল্লির যৌনপল্লিতে পাঠানো হয়।
❖ দারিদ্র্যই মূল কারণ
বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল এখনো চরম দারিদ্র্যের শিকার। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও বেকারত্বের সুযোগ নেয় এই পাচারকারী চক্র। অনেক সময় স্থানীয় এজেন্টরা মাছ ধরা বা শ্রমিকের কাজের অজুহাতে মেয়েদের ভারতে যাওয়ার প্রলোভন দেয়। সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহ।
একজন ভুক্তভোগী নারী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন—
“আমাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতে আনা হয়েছিল। কিন্তু এখানে এসে দেখি আমার সব কাগজপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পালানোর কোনো উপায় নেই, বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হয়েছে।”
❖ বাংলাদেশি নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক
ভারতের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ বোর্ড (CSWB) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে যে সকল নারী যৌন শোষণের শিকার হচ্ছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ২.৭ শতাংশ বাংলাদেশি নারী। অর্থাৎ হাজার হাজার বাংলাদেশি নারী ভারতে পাচার হয়ে যৌনপল্লিতে আটকা পড়ে আছেন।
গবেষণা অনুযায়ী, এই নারীদের বেশিরভাগকে কলকাতা, দিল্লি, হায়দরাবাদ ও মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরে দালালদের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
❖ সক্রিয় পাচার চক্রের কেন্দ্রবিন্দু
হায়দরাবাদে পাচারকারী নেটওয়ার্ক সবচেয়ে বেশি সক্রিয় আত্তাপুর, বান্দলাগুডা, চিন্তালমেট, হিমায়াতসাগর রোড ও চম্পাপেট এলাকায়। এখানে বহুদিন ধরে বাংলাদেশি, নেপালি ও অন্যান্য দেশের নারী জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছেন।
❖ আন্তঃদেশীয় মাফিয়া নেটওয়ার্ক
মানব পাচার এখন শুধুমাত্র স্থানীয় কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক মাফিয়া ব্যবসা। বাংলাদেশ থেকে দালালরা মেয়েদের ভারতে পাঠালেও ভারতের ভেতরে রয়েছে শক্তিশালী মাফিয়া সিন্ডিকেট। তারা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা চালাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী মানব পাচার এখন মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার পর সবচেয়ে লাভজনক অপরাধ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর লাখ লাখ নারী ও শিশু পাচারের শিকার হন। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
❖ আইন ও উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করেছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ অনুযায়ী পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন করলেই হবে না, পাচার প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।
বিশেষজ্ঞের মতামত
ঢাকার সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার গবেষকরা মনে করেন—
- পাচার রোধে প্রথমেই দরকার গ্রামীণ এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
- সীমান্তে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে যৌথ বাংলাদেশ-ভারত অভিযান চালানো জরুরি।
- ভুক্তভোগীদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
- সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া পাচার পুরোপুরি থামানো সম্ভব নয়।
MAH – 12376 , Signalbd.com



