৯ জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হামাসের

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস গাজায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসানে নতুন একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, হামাস ৯ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে, যদি ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি মেনে নেয় এবং নির্দিষ্ট কিছু মানবিক শর্ত পূরণ করে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র।
এই প্রস্তাব এমন এক সময় এসেছে যখন গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল নতুন করে ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করেছে। চলমান সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে শত শত ফিলিস্তিনি। খাদ্য, চিকিৎসা ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে পুরো অঞ্চলজুড়ে।
হামাসের নতুন প্রস্তাব: যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও স্কাই নিউজ আরাবিয়ার বরাতে জানা গেছে, হামাস যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে—
- ৯ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে,
- গাজায় প্রতিদিন ৪০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি চেয়েছে,
- এবং চিকিৎসার জন্য রোগীদের গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ চেয়েছে।
এই প্রস্তাবের মূল ভিত্তি হলো ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি, যার মাধ্যমে গাজার ভেতরের মানবিক দুর্দশা কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হতে পারে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া: শর্তহীন যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ
ইসরায়েল এখনো হামাসের এই প্রস্তাবে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে আলোচনার আগে দেশটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল—
তারা গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না এবং যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসানেও প্রতিশ্রুতি দেবে না।
এর মানে, হামাসের প্রস্তাবে থাকা যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার শর্তগুলো হয়তো ইসরায়েলের নিরাপত্তা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে সীমিত সময়ের যুদ্ধবিরতি হলেও, চূড়ান্ত চুক্তির দিকে এগোনোর সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত।
‘অপারেশন গিদিওনস চ্যারিয়ট’: নতুন করে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু
হামাসের প্রস্তাব আসার আগে গতকাল শনিবারই ইসরায়েল ‘অপারেশন গিদিওনস চ্যারিয়ট’ নামে একটি নতুন সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এটি গাজায় সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ঘটনার সারসংক্ষেপ:
- বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত চলা অভিযানে অন্তত ৩০০ জন নিহত হয়েছে।
- নিহতদের মধ্যে হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত সাধারণ মানুষ রয়েছে।
- ইসরায়েলের আক্রমণে গাজার উত্তর ও দক্ষিণে হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী মানবিক সংস্থাগুলো ও সংবাদমাধ্যমগুলো একে গণহত্যার শামিল হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ভেঙে পড়েছে পূর্ববর্তী যুদ্ধবিরতি
গত ১৮ মার্চ দুই মাসের একটি যুদ্ধবিরতি ভেঙে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। এরপর থেকে গত দুই মাসে গাজায় ৩,০০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে নারী, শিশু, ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি।
ইসরায়েলের আক্রমণের ফলে গাজার ভেতরে খাদ্য, পানি, ও চিকিৎসা সহায়তার ভয়াবহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২১ লাখ গাজাবাসীর মধ্যে বেশিরভাগই এখন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।
খাদ্যকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল?
গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে বিবিসির সংবাদদাতা গাদা আল-কুর্দ জানিয়েছেন, তাঁর পরিবার এখন দিনে মাত্র একবার খাবার খেতে পারছে। তিনি বলেন,
“ইসরায়েল খাদ্য ও পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি একটি নিষ্ঠুর কৌশল।”
জাতিসংঘের মানবিক সংস্থাগুলো ও চিকিৎসা সংস্থাগুলোর মতে, শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি এতটাই বেড়েছে যে অনেকের শরীরে কঙ্কালসার চেহারা ফুটে উঠছে। মানবিক সাহায্যের ট্রাকগুলোকেও ইসরায়েল বারবার সীমান্তে আটকে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
গাজার চলমান সংকটে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ, ও ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি সবাই স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে বলেছে,
“নতুন হামলা গাজার জনসংখ্যা ও জিম্মিদের ভয়াবহ মানবিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলছে।”
তবে এখনো পর্যন্ত পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই পুরোপুরি ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যদিও তারা মানবিক সহায়তা প্রবেশে কিছুটা চাপ প্রয়োগ করছে।
নেতানিয়াহুর ঘোষণা: হামাসকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ থামবে না
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চলতি মাসের শুরুতে বলেন—
“হামাসকে ধ্বংস করা, গাজা দখল নেওয়া, এবং ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে সরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।”
এই অবস্থান থেকে সরে এসে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হওয়া নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিকভাবে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এতে ইসরায়েলি জনমত ও কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষুব্ধ হতে পারে।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মানবিক সংকট রোধের শেষ সুযোগ?
হামাসের যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে গাজার নির্যাতিত মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তির সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে ইসরায়েলের কঠোর অবস্থান এবং চলমান সামরিক আগ্রাসন এই সম্ভাবনাকে বিপন্ন করে তুলেছে।
যদি কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তাহলে গাজায় আরও হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এখন আশা করছে—দোহায় চলমান আলোচনা থেকে অন্তত মানবিক যুদ্ধবিরতির একটি সূচনা সম্ভব হবে।