পূবালী ব্যাংক, দুর্বল অবস্থা থেকে শীর্ষ পর্যায়ে উত্তরণের গল্প

পূবালী ব্যাংক, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ১৯৫৯ সালে ‘ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে ব্যাংকটি জাতীয়করণ করে নামকরণ করা হয় ‘পূবালী ব্যাংক’। তবে, জাতীয়করণের পর বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে ঋণ অনিয়মের কারণে ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ে।
বেসরকারিকরণ ও পুনর্জন্ম
১৯৮৩ সালে ব্যাংকিং খাতে বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির প্রেক্ষিতে, ১৯৮৪ সালে পূবালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়। নতুন উদ্যোক্তারা ব্যাংকটির সংস্কারে মনোনিবেশ করেন, কর্মীদের সেবা মানসিকতার উন্নতি ঘটান এবং ঋণ আদায়ে জোর দেন। অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হয়।
প্রযুক্তির সাথে অভিযোজন
২০০৯ সালে পূবালী ব্যাংক কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) চালু করে। এরপর থেকে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে ভিসা, মাস্টারকার্ড, কিউ ক্যাশ কার্ড সেবা, নিজস্ব এটিএম, সিআরএম সেবা চালু করা হয়। গ্রাহকদের জন্য নতুন সেবা ও শাখাগুলোর আধুনিকায়নের মাধ্যমে ব্যাংকটি গ্রাহকসেবায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে।
নেতৃত্বের ভূমিকা
পূবালী ব্যাংকের উন্নতিতে দক্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৭ সালে ব্যাংকে যোগদান করে ২০০৬ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান হেলাল আহমেদ চৌধুরী। তার পূর্বে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছয় বছর এমডির দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নেতৃত্বে ব্যাংকটি সুশাসন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে।
ধারাবাহিক উন্নতি
১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৫৪১ কোটি টাকা এবং ঋণ ছিল ৪৩৩ কোটি টাকা। ২০০০ সালে আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৩,০১০ কোটি টাকায় এবং ঋণের স্থিতি ছিল ২,১৫৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে পূবালী ব্যাংকের আমানত বেড়ে হয়েছে ৭৪,৫২৩ কোটি টাকা এবং ঋণ ৬২,৯২৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার কমে নেমে এসেছে ২.৬৭ শতাংশে। গত বছর ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ২,৩২৯ কোটি টাকা।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ১,১৫৬ কোটি টাকা এবং কর্মীর সংখ্যা ১০,৬৭৮ জন। সারা দেশে ৫০৮টি শাখা ও ২২৭টি উপশাখা নিয়ে পূবালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ নেটওয়ার্ক নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
পূবালী ব্যাংক ভবিষ্যতে বহুজাতিক ব্যাংকে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা চালুর সাথে তাল মিলিয়ে পূবালী ব্যাংকও তাদের সেবা সম্প্রসারণে উদ্যোগী। এছাড়া, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ঋণ বিতরণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
পূবালী ব্যাংকের এই উত্তরণের গল্প প্রমাণ করে যে, সুশাসন, প্রযুক্তির সাথে অভিযোজন এবং দক্ষ নেতৃত্বের সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠান দুর্বল অবস্থা থেকে শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে পূবালী ব্যাংক একটি উদাহরণস্বরূপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।