বিশ্ব

মণিপুরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্ত্র সমর্পণ, অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ল

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র সমর্পণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের পর রাজ্যটিতে রাষ্ট্রপতি তথা কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। এরপর থেকেই মেইতেই সম্প্রদায় ও কুকিসহ অন্যান্য জাতির সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য সাত দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তবে রাজ্যের নতুন রাজ্যপাল ও সাবেক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয়কুমার ভাল্লার নির্দেশে এই সময়সীমা ৬ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

আরামবাই টেঙ্গোলের অস্ত্র সমর্পণ

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মণিপুরের অন্যতম সশস্ত্র মেইতেই গোষ্ঠী ‘আরামবাই টেঙ্গোল’ প্রথম দফায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সমর্পণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকটি গাড়িতে করে টেঙ্গোলের সদস্যরা ইম্ফলের মণিপুর রাইফেলস ব্যাটালিয়ন গ্রাউন্ডে প্রবেশ করছেন। ছাদখোলা পিকআপ ভ্যানভর্তি রকেট লঞ্চার, মর্টার, স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, মেশিনগান ও প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে তাঁরা অস্ত্র জমা দেন।

প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, আরামবাই টেঙ্গোল এখন পর্যন্ত মোট ২৪৬টি প্রাণঘাতী অস্ত্র সমর্পণ করেছে। তবে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শর্ত পূরণ হলেই তারা বাকি অস্ত্র জমা দেবে। সংগঠনের জনসংযোগ কর্মকর্তা রবিন মাঙ্গাং খোয়াইরাকপাম জানিয়েছেন, ‘রাজ্যপাল ভাল্লা আমাদের বেআইনি অস্ত্র জমা দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আমরা কিছু শর্ত দিয়েছি এবং তিনি তা বিবেচনা করছেন। শর্তগুলো পূরণ হলে আমরা সব অস্ত্র সমর্পণ করব।’

কুকি ও অন্যান্য জাতির অস্ত্র জমা

শুধু মেইতেই গোষ্ঠী নয়, পার্বত্য অঞ্চলের কুকি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠনগুলোও অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে মণিপুর পুলিশের তালিকা অনুযায়ী, চারটি পার্বত্য জেলা থেকে ১০৯টি অস্ত্র জমা পড়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, রকেট লঞ্চার, মর্টার, গ্রেনেড, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও ওয়্যারলেস সেটও রয়েছে।

রাজ্যের লুট হওয়া অস্ত্র ফেরত আসছে

মণিপুরে বিগত দেড় বছরে ব্যাপক সংঘাতের সময় বিভিন্ন অস্ত্রাগার, থানা ও চৌকি থেকে ২,৫০০ থেকে ৬,০০০ পর্যন্ত অস্ত্র লুট হয়েছে বলে প্রশাসনের ধারণা। বর্তমানে সেই অস্ত্রগুলোই ধাপে ধাপে ফিরতে শুরু করেছে। পাশাপাশি, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে কুকিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর হাতে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র পৌঁছানোর অভিযোগও উঠেছিল। এখন প্রশাসন চাইছে, রাজ্যের শান্তি ফেরানোর স্বার্থে এসব অস্ত্র সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনা হোক।

অস্ত্র জমার পরও শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে

বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্ত্র জমার হার বৃদ্ধি পেলেও এখনো বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে বিপুল অস্ত্র রয়ে গেছে। একজন প্রবীণ সাংবাদিক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরের সশস্ত্র আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একটি স্বয়ংক্রিয় বন্দুক যদি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাহলে তা অনায়াসে ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। সুতরাং, অস্ত্র জমার পরও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে রাজ্যে সব অস্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।’

রাষ্ট্রপতির শাসন ও ভবিষ্যৎ শান্তি

২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুরে জাতিগত সংঘাত শুরু হয়, যার ফলে দেড় বছরের মধ্যে আড়াই শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং পদত্যাগ করার পর কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে।

এখন প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্রপতির শাসনের অধীনে অস্ত্র সমর্পণের প্রক্রিয়া কি সত্যিই রাজ্যে স্থায়ী শান্তি আনতে পারবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্ত্র জমার হার বাড়লেও সামাজিক ও রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া মণিপুরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। কেন্দ্র সরকারের উচিত জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের মাধ্যমে একটি স্থায়ী শান্তির পথ খুঁজে বের করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button