বিশ্ব

যুক্তরাজ্য ঘোষণা করেছে শতাধিক নতুন নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাজ্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধকে সমর্থনকারী দেশ এবং সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নতুন করে ১০০টিরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আক্রমণের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিশ্রুতি আরও জোরদার করতে চায়।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলি রাশিয়ার সামরিক বাহিনী, তৃতীয় দেশগুলোর সমর্থক সংস্থা এবং সেইসব সরবরাহ নেটওয়ার্কগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করবে, যা যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে আসছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এ পদক্ষেপকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে, এটি ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রতিশ্রুতি এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির জন্য এক বড় পদক্ষেপ।

এই নিষেধাজ্ঞাগুলির মধ্যে প্রথমবারের মতো বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে কিরগিজস্তানভিত্তিক ওজেএসসি কেরেমেত ব্যাংক উল্লেখযোগ্য। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে, যুক্তরাজ্য রাশিয়ার যুদ্ধ সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সিস্টেমের উপর চাপ বাড়াতে চাইছে।

এছাড়াও, রাশিয়ার কথিত ‘ছায়া নৌবহর’কে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে রাশিয়া পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য সাগরপথে তেল এবং অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানি করে। ৪০টি নতুন জাহাজ এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে, যা রাশিয়ার ১৩৩টি নিষিদ্ধ জাহাজের তালিকাকে আরও দীর্ঘ করেছে।

রাশিয়ার সমর্থক দেশগুলো এবং তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাজ্যের এই নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজটি মূলত রাশিয়ার যুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশগুলোকে লক্ষ্য করছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে কিছু মধ্য এশীয় দেশ, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, ভারত এবং চীন। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে, যুক্তরাজ্য যুদ্ধকে সমর্থনকারী তৃতীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে।

একই সময়ে, উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী নো কওয়াং চোল সহ কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ১১ হাজারেরও বেশি উত্তর কোরিয়ান সেনা মোতায়েনের জন্য রাশিয়ার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। ব্রিটেন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়ার যুদ্ধপরিকল্পনা এবং তাদের মিত্রদের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।

ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রতিশ্রুতি

ডেভিড ল্যামি আরও বলেছেন, ‘‘এটি ইউক্রেনের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি জোরদার করছে। আমাদের লক্ষ্য হল, প্রতিটি সামরিক সরবরাহ লাইন ভেঙে দেওয়া এবং পুতিনের আগ্রাসনকে সমর্থনকারীদের একে একে প্রকাশ করা।’’ এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্য আশা করছে, রাশিয়ার যুদ্ধশক্তি আরও দুর্বল হবে এবং শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো এই পদক্ষেপে একটি শক্তিশালী বার্তা দেখছে যে, তারা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ। তবে, এই নিষেধাজ্ঞাগুলির বাস্তবিক প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা আরও অনেক চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করছেন। বিশেষত, তৃতীয় দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং রাশিয়ার সমর্থক দেশগুলোর প্রতিবাদ যেকোনো সময় ইউরোপীয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে বিপদে ফেলতে পারে।

ব্রিটেন-আমেরিকা সম্পর্ক এবং যুদ্ধের সমাপ্তি

যুক্তরাজ্য সরকারের এই নতুন পদক্ষেপ এমন একটি সময়ে এসেছে যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের জন্য ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন। এই বৈঠকটি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করার লক্ষ্যে, যাতে যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য আঞ্চলিক এবং নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা যায়।

কিন্তু, ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে সম্প্রতি প্রকাশিত বিরোধ এই বৈঠকটি আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ‘স্বৈরশাসক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ‘সফল আলোচনা’ করার পক্ষে সওয়াল করেছেন।

ইউরোপের কিছু দেশ আশঙ্কা করছে যে, ট্রাম্পের চাপের কারণে যদি ইউক্রেন কোন অসম চুক্তিতে পৌঁছায়, তবে তা পুতিনের বিজয়ের দাবি নিশ্চিত করবে এবং ইউরোপের সামনে রাশিয়ার এক নতুন শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে। এর ফলে, ইউরোপে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে যা শান্তির পক্ষে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক উত্তেজনা

যতই নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক না কেন, রাশিয়া এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে এবং তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত, যুক্তরাজ্যের সামরিক সরবরাহ লাইন ভাঙার প্রচেষ্টা এবং রাশিয়ার শত্রু দেশগুলোর বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের অন্যান্য অংশে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে।

এদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, রাশিয়া সম্ভবত আরও বেশি করে চীন, ভারত, তুরস্ক এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চেষ্টা করবে। এর ফলে, পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার মধ্যে এক নতুন ধরনের আর্থিক ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য একটি নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের জন্ম দিতে পারে।

শেষ কথা

যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজটি শুধুমাত্র ইউক্রেনের প্রতি ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতি জোরদার করবে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বের বৃহত্তর নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পরিবেশে পরিবর্তন আনতে পারে, যা সময়ের সঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button