জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে : গভর্নর

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শেষ মাস জুন নাগাদ দেশে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশে নামবে এবং আগামী অর্থবছরের মধ্যে তা ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সোমবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
গভর্নর বলেন, “প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এটি একটি ইতিবাচক সংকেত। সামনের দিনগুলোতে মুদ্রানীতির কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির হার আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।”
নতুন মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত মুদ্রানীতির বিবৃতিতে মূলত চারটি লক্ষ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে:
- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ – ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো এবং সাধারণ জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব হ্রাস করা।
- বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা – ডলারের বিনিময় হার স্বাভাবিক রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি – আমদানি ব্যয় কমিয়ে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়িয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করা।
- খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির সমাধান – ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা।
নীতি সুদহার অপরিবর্তিত
নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো রেট, যা নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিত, ১০ শতাংশেই রাখা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার আর না বাড়িয়ে টাকার সরবরাহকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে চেয়েছে।
নতুন মুদ্রানীতির আওতায়:
- স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) বা ঋণ বিতরণে সুদহার ১১.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
- স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) বা আমানতে সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ থাকবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের অর্থনীতির জন্য বেশকিছু ঝুঁকির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- আঞ্চলিক সংঘাতের প্রভাব – বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি আমদানি-রপ্তানি বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা – দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।
- বৈদেশিক ঋণ বাজারের চাপ – বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
- সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যনীতি – বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোর সংরক্ষণবাদী নীতি বাংলাদেশের রপ্তানিখাতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “দৃঢ় নীতিগত অবস্থান ও প্রধান অংশীদারদের সহযোগিতার মাধ্যমে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির হার আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।”
বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৯.৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধেও একই ছিল। অপরদিকে, সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির হার পূর্বের ১৪.২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে সরকার কৌশলগত ব্যয় সংকোচন ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে?
মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে:
- টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ – অপ্রয়োজনীয় মুদ্রা প্রবাহ কমিয়ে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
- ব্যাংকগুলোর উপর নজরদারি বৃদ্ধি – ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
- খেলাপি ঋণ হ্রাসে কড়াকড়ি – ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
- রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করা – প্রবাসী আয় বাড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনা ও সুবিধা প্রদান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের এই মুদ্রানীতি যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে আগামী জুনের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসবে এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি আরও কমানো সম্ভব হবে।”
সার্বিক মূল্যায়ন
বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এই মুদ্রানীতিকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। তবে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, “যদি নীতিমালাগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং সরকারের সহযোগিতা থাকে, তাহলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা সম্ভব হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা নির্ভর করবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। তবে সামগ্রিকভাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।