মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন মোড়

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেছেন। আজ রোববার সন্ধ্যায় তিনি রাজ্যের রাজ্যপাল অজয়কুমার ভাল্লার কাছে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। আগামীকাল সোমবার রাজ্যের বিধানসভায় সম্ভাব্য অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হওয়ার আগেই বিজেপির এই নেতা এ সিদ্ধান্ত নিলেন।
অনাস্থা প্রস্তাবের পূর্বাভাস
গত কয়েক মাস ধরেই মণিপুর রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল অবস্থায় ছিল। বিজেপির বেশ কয়েকজন বিধায়ক প্রকাশ্যে বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ধারণা করা হচ্ছিল যে, ৬০ সদস্যের মণিপুর বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন তিনি। এ অবস্থায়, বিজেপির আদিবাসী বিধায়করা এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস একত্র হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
আজ সকালে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে দিল্লিতে তলব করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে আলোচনা চলে। বৈঠকে বীরেন সিংয়ের সঙ্গে বিজেপি ও নাগা পিপলস ফ্রন্টের (এনপিএফ) ১৪ জন বিধায়ক উপস্থিত ছিলেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বীরেন সিং বেশি সংখ্যক বিধায়কের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। বৈঠকের পর তিনি জানান, মণিপুর ফিরে গিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করবেন।
ইম্ফলে ফিরে পদত্যাগ
দিল্লির বৈঠক শেষ করে আজ বিকেলে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে পৌঁছান বীরেন সিং। এরপর রাজ্যপাল অজয়কুমার ভাল্লার কাছে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মণিপুরে বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সম্বিত পাত্র এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি এ শারদা দেবী।
পদত্যাগপত্রে কী বলেছেন বীরেন সিং?
বীরেন সিং তাঁর পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মণিপুরের প্রতিটি নাগরিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, মণিপুরের উন্নয়নে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সবসময় তাঁর পাশে ছিল।
বীরেন সিং তাঁর পদত্যাগপত্রে আরও লিখেছেন, “মণিপুরের হাজার বছরের পুরাতন সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সভ্যতার সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত একটি শক্তিশালী নীতি প্রণয়ন করা। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে এবং মাদক চোরাচালান রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: কেন এই পদত্যাগ?
বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ ভারতীয় রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, গত এক বছর ধরে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায় ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বীরেন সিংয়ের প্রতি আস্থা হারায়। ফলে বিজেপি নেতৃত্ব তাঁকে সরিয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের পরিকল্পনা করে।
বিজেপির ভবিষ্যৎ কৌশল
মণিপুরে নতুন নেতৃত্ব বাছাই এখন বিজেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা বিজেপির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বিজেপির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কয়েকজন প্রবীণ নেতার নাম আলোচনায় রয়েছে, তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের পর বিরোধী দল কংগ্রেস একে “জনগণের বিজয়” বলে উল্লেখ করেছে। কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি বলেন, “বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ প্রমাণ করে যে, বিজেপির সরকার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সময় এসেছে মণিপুরের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার।”
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
বীরেন সিংয়ের বিদায়ের পর মণিপুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বিজেপি খুব শিগগিরই নতুন মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করবে। অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইবে।
উপসংহার
বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ মণিপুর রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি শুধু বিজেপির অভ্যন্তরীণ সংকটকেই চিহ্নিত করছে না, বরং রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সামাজিক অস্থিরতাকে আরও গভীরভাবে তুলে ধরছে। এখন দেখার বিষয়, বিজেপি কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে এবং মণিপুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে অগ্রসর হয়।