আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে মাঠে গড়াতে যাওয়া আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দশম আসরের মাত্র দুয়েক মাস আগেই বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি (ICC)। ভারতীয় এক প্রতিষ্ঠানের কারণে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। রিলায়েন্সের জিওস্টার (GeoStar) তাদের ২০২৪-২০২৭ সাল পর্যন্ত চার বছরের সম্প্রচার চুক্তি বাতিল করায় আইসিসি’র প্রায় ৭,৩৩৮ কোটি টাকা (৬০ কোটি ডলার) ক্ষতি হতে যাচ্ছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমস এক প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে। হঠাৎ চুক্তি বাতিলের ঘটনায় আইসিসি বিকল্প সম্প্রচারক খুঁজতে মাঠে নেমেছে, কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকার কারণে কেউই চুক্তিতে রাজি হচ্ছে না।
জিওস্টারের চুক্তি বাতিল: আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ
আইসিসি এবং রিলায়েন্সের জিওস্টারের মধ্যে ২০২৪ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত চার বছরের জন্য সম্প্রচার চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী আইসিসি প্রতি বছর ৩০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৬,৬৮৮ কোটি টাকা) পাওয়ার কথা ছিল।
চুক্তি বাতিলের ঘোষণা: জিওস্টার হঠাৎ করেই চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে, অথচ চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে এখনও দুই বছর বাকি।
ক্ষতির পূর্বাভাস: ২০২৬ থেকে ২০২৯ সালের চক্রের জন্য যে নতুন চুক্তির কথা উঠেছে, তাতে প্রতি বছরে আইসিসির কোষাগারে যুক্ত হবে মাত্র ২৪০ কোটি ডলার (প্রায় ২৯,৩৫০ কোটি টাকা)।
মোট আর্থিক ক্ষতি: অর্থাৎ, আগের চুক্তির তুলনায় আইসিসির প্রতি বছর ৬০ কোটি ডলার কম আয় হবে। বাংলাদেশি টাকায় এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭,৩৩৮ কোটি টাকা!
আইসিসির আয়ের একটি প্রধান উৎস হলো সম্প্রচার স্বত্ব। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি ক্রিকেটের বৈশ্বিক ইভেন্টগুলোর আয়োজন এবং ছোট দেশগুলোর ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
জিওস্টারের ক্ষতির কারণ: ভারত সরকারের নতুন আইন
জিওস্টার কেন এই বিশাল আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হলো, তার মূল কারণ লুকিয়ে আছে ভারত সরকারের নতুন এক সিদ্ধান্তে।
রিয়েল মানি গেমিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা: ভারতীয় সরকার সম্প্রতি রিয়েল মানি গেমিংয়ের (বাজি বা জুয়া) ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জিওস্টারের আয়ের একটি বড় অংশ আসত এই গেমিং ও বাজি কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন থেকে।
কোম্পানি বন্ধ: ড্রিম ইলেভেন (Dream11), মাই ইলেভেন সার্কেল (My11Circle)-এর মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার কারণে জিওস্টারের প্রায় ৭,০০০ কোটি রুপি ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯,৫০০ কোটি টাকারও বেশি।
এই বিপুল লোকসানের কারণেই জিওস্টার বাধ্য হয়ে আইসিসির সঙ্গে তাদের সম্প্রচার চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইসিসির বিকল্প সন্ধানের চেষ্টা
জিওস্টার চুক্তি বাতিল করলেও, আইসিসি এই বিশাল আর্থিক শূন্যতা পূরণের জন্য দ্রুত বিকল্প সম্প্রচারক খুঁজতে মাঠে নেমেছে।
যোগাযোগ: আইসিসি সনি পিকচার নেটওয়ার্কস ইন্ডিয়া, নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
সাফল্যের অভাব: তবে দ্য ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, চুক্তির জন্য যে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হচ্ছে, তার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানই আইসিসির সঙ্গে সম্প্রচার স্বত্বের চুক্তিতে সহজে রাজি হচ্ছে না।
আইসিসি যদি নতুন কোনো সম্প্রচারক খুঁজে না পায়, তবে আইসিসি জিওস্টারকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত চুক্তি চালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে।
ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও বিস্ফোরক মন্তব্য
এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের আর্থিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। সাবেক আইসিসি ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড এর আগে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বলেছিলেন, “টাকার জোরে আইসিসি দখল করেছে ভারত।”
ব্রডের অভিযোগ: তিনি অভিযোগ করেন, ধীরগতির ওভার রেটের জন্য ভারতকে শাস্তি না দিয়ে ‘সহনশীল’ হওয়ার জন্য তাঁকে ফোন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “ভারত এখন পুরো আইসিসি দখল করে নিয়েছে, কারণ টাকার মালিক তারা।”
জিওস্টারের চুক্তি বাতিল এবং আইসিসির বিপুল লোকসান প্রমাণ করে যে, ভারতীয় বাজারের অর্থনৈতিক ক্ষমতা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থাকে কীভাবে প্রভাবিত করে।
আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজন
আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দশম আসর আগামী ২০২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারত ও শ্রীলঙ্কায় মাঠে গড়াবে। ফাইনাল হবে ৮ মার্চ।
ফাইনালের ভেন্যু: যদি পাকিস্তান ফাইনালে ওঠে, তবে ফাইনাল হবে শ্রীলঙ্কায়। অন্যথায়, ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে ভারতের আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে।
এই বিশ্বকাপ সামনে রেখে আইসিসির এই আর্থিক সংকট টুর্নামেন্ট আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
আর্থিক সংকটে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ
রিয়েল মানি গেমিংয়ের ওপর ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার জেরে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান জিওস্টারের সম্প্রচার চুক্তি বাতিল করায় আইসিসিকে প্রায় ৭,৩০০ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর্থিক নির্ভরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকিকে স্পষ্ট করেছে। আইসিসিকে দ্রুত বিকল্প সম্প্রচারক খুঁজে বের করে এই আর্থিক সংকট কাটাতে হবে, অন্যথায় বৈশ্বিক ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এম আর এম – ২৫৪৬, Signalbd.com



