বিশ্ব

পাকিস্তানের হামলায় অন্তত ২৩ আফগান সেনা নিহত

Advertisement

দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র—পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। ধর্মীয়, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। বিশেষ করে চামান–স্পিন বোলদাক সীমান্ত অঞ্চলটি গত কয়েক বছর ধরে সংঘর্ষ, গোলাগুলি, সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

২০২৫ সালের ৫ ও ৬ ডিসেম্বর আবারও সেই সীমান্তেই দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ২৩ আফগান তালেবান সেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ। রোববার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা হামলায় আফগান বাহিনীর একাধিক বাংকার ও চেকপোস্ট সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।

ঘটনাটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক কয়েক মাসে এই অঞ্চলে সীমান্ত সংঘর্ষের হার দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে কেবল সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্রমাবনতি বলেই মনে করছেন।

চামান সীমান্ত: কেন বারবার সংঘর্ষ?

চামান–স্পিন বোলদাক সীমান্তকে আফগানিস্তান “আফগান ভূখণ্ডের অংশ” দাবি করে আসছে, অন্যদিকে পাকিস্তান এটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডুরান্ড লাইনের অংশ বলে মনে করে। দুই দেশের মধ্যে এই ভূ-সীমানা স্বীকৃত না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে উত্তেজনা অব্যাহত।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়—

  • ২০২२ সালে একাধিকবার গোলাগুলি
  • ২০২৩ সালে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান
  • ২০২৪ সালে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে কড়াকড়ি
  • ২০২৫ সালে তালেবান ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সীমান্তে সেনা বাড়ায়

এভাবে সামরিক উত্তেজনার পাশাপাশি বাণিজ্য, অভিবাসন ও নিরাপত্তাজনিত জটিলতা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলছে।

৫ ডিসেম্বর রাত: সংঘর্ষের সূত্রপাত

পাকিস্তানের সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ১২টার দিকে চামান সীমান্তের জামান সেক্টরে হঠাৎ করেই ছোট অস্ত্র দিয়ে প্রথম গুলি ছোড়ে আফগান তালেবান সেনারা। পাকিস্তানের দাবি, এটি ছিল যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

তবে আফগান তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা তৎক্ষণাৎ জানা যায়নি। তারা বরাবরই পাকিস্তানের সেনাদের বিরুদ্ধে “অকারণ উসকানি” ও “অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের” অভিযোগ করে আসছে।

পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক জবাব: ৪৫ মিনিটের গোলাগুলি

আফগানিস্তানের গুলির পর পাকিস্তান সেনারা দ্রুত পাল্টা জবাব দেয়। পাকিস্তানি সূত্রের দাবি—

  • প্রথমে কেবল হালকা অস্ত্র ব্যবহার
  • দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তীব্র গুলিবিনিময়
  • পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় পাকিস্তান পরে ভারী অস্ত্র মোতায়েন

ভারী অস্ত্রগুলোর মধ্যে ছিল—

  • রকেট লঞ্চার
  • মর্টার শেল
  • ভারী মেশিনগান
  • আর্টিলারি কামান

এগুলো ব্যবহারে আফগান পক্ষের তিনটি চেকপোস্ট “সম্পূর্ণ ধ্বংস” হয়েছে বলে দাবি করে পাকিস্তানি গণমাধ্যম।

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের ভারী অস্ত্রের ব্যবহার সাধারণত নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখা হয় না। এতে সীমান্ত অস্থিরতা বাড়ার ঝুঁকি থাকে।

“সিভিলিয়ান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়”—পাকিস্তানের দাবি

পাকিস্তানি সামরিক সূত্র জানিয়েছে, পুরো হামলায় তারা “নির্ভুল টার্গেটিং প্রযুক্তি” ব্যবহার করে। উদ্দেশ্য ছিল—আফগান সেনাদের লক্ষ্যবস্তু করা, সাধারণ মানুষকে নয়।

কিন্তু পরবর্তীতে অভিযোগ ওঠে যে, আফগান তালেবান যোদ্ধারা জনবহুল এলাকায় আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকে पाकिस्तानি সেনাদের ওপর আবারও গুলি চালায়। ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।

পাকিস্তান দাবি করে, তারা বাধ্য হয়েই সেই এলাকাগুলোতেও গোলা ছুঁড়েছে—তবে “সীমিত মাত্রায়”।

এ ঘটনার স্বচ্ছতা নিয়ে এখনো বিতর্ক থাকলেও স্থানীয় সূত্রের খবর—সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে রাতেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।

আফগান তালেবানের নীরবতা: কৌশলগত নাকি দুর্বলতা?

এ ঘটনার পরও আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে—

  1. তালেবান প্রশাসন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সংকটে ভুগছে, তাই বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনা নিয়ে তারা তাড়াহুড়ো করে বিবৃতি দিতে চায় না।
  2. পাকিস্তান ও তালেবানের সম্পর্ক গত এক বছরে দ্রুত খারাপ হয়েছে। উভয়ই অপর পক্ষকে “সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া”র অভিযোগ করছে।
  3. তালেবানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি—বিশেষ করে বালোচিস্তান ও খাইবার অঞ্চলে আইএস–খোরাসানের সক্রিয়তা—এ উত্তেজনাকে জটিল করে তুলছে।

তালেবান হয়তো আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

২০২৫ সালের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: সংঘর্ষ কেন বাড়ছে?

২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থিতিশীল। সাম্প্রতিক তথ্যগুলো তুলে ধরলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়—

১. আফগানিস্তানে নিরাপত্তা সংকট

তালেবান সরকার সন্ত্রাসী হামলা, আইএস–খোরাসানের উত্থান এবং অর্থনৈতিক সংকটে মানসিকভাবে চাপে রয়েছে।

২. পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান

পাকিস্তান ২০২৫ সাল থেকে “অপারেশন ট্রু শিল্ড” নামে নতুন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে। এতে তারা সরাসরি আফগানিস্তানকে দোষারোপ করে বলছে—“TTP (তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান) যোদ্ধারা আফগান ভূ-সীমানা থেকে পাকিস্তানে ঢুকছে”।

৩. আন্তর্জাতিক শক্তির স্বার্থ

চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া—তিন পক্ষই আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলে বাড়তি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প, মধ্য এশিয়ার রুট, বাণিজ্য–ট্রানজিট—সবকিছুই এই অঞ্চলে নির্ভর করছে।

৪. ডুরান্ড লাইন ইস্যু

ডুরান্ড লাইনকে নিয়ে দুই দেশ কখনোই একমত হয়নি। এটি সংঘর্ষের মূল গিরা।

চামান সীমান্ত: সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ

চামান সীমান্ত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক পথ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ—

  • বাজারে কেনাকাটা
  • ভ্রমণ
  • চিকিৎসা
  • পারিবারিক যোগাযোগ
  • পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল

এসব কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে।

সংঘর্ষের কারণে—

  • পথ বন্ধ হয়ে যায়
  • বাণিজ্য স্থবির হয়
  • ট্রাক চালকেরা কয়েক কিলোমিটার দূরে আটকে পড়ে
  • ব্যবসায়ীরা বড় ক্ষতির মুখে
  • দিনে দিনে বেড়ে যায় খাদ্য সংকট
  • সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে

এমনকি ২০২৩–২৪ সালে এই সীমান্তে সংঘর্ষে বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল, যার পুনরাবৃত্তি আবারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

মার্কিন বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের সংঘর্ষ বাড়লে—

  • আফগানিস্তানে চরমপন্থীরা শক্তিশালী হবে
  • পাকিস্তানের অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে
  • চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে
  • মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যরুট অস্থিতিশীল হবে

জাতিসংঘ

জাতিসংঘের দক্ষিণ এশিয়া দপ্তর বলেছে—
“উভয় দেশকে সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বনের আহ্বান জানানো হচ্ছে।”

তবে জাতিসংঘ এখনো কোনও তদন্ত কমিটি গঠন করেনি।

পাকিস্তানের দাবি: “আমরা আত্মরক্ষায় বাধ্য হয়েছি”

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বরাবরই দাবি করে আসছে—

  • আফগান সীমান্ত থেকে অনুপ্রবেশ
  • তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে TTP-কে নিরাপদ আশ্রয়
  • পাকিস্তানের চেকপোস্টে বরাবরই উসকানিমূলক গুলিবর্ষণ

তারা বলছে, এসবের প্রতিক্রিয়ায় অভিযানে শক্তি প্রয়োগ করা ছাড়া তাদের উপায় নেই।

আফগানিস্তানের দাবি: “পাকিস্তান অকারণ আক্রমণ করছে”

আফগান তালেবান পাল্টা অভিযোগ করে—

  • পাকিস্তান সীমান্ত বেআইনি ভাবে সরিয়ে নিতে চায়
  • আফগান ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে
  • অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে
  • সীমান্তে ট্রেড বন্ধ করে অর্থনীতি ধ্বংস করছে

অর্থাৎ উভয় পক্ষই পরস্পরকে দায়ী করছে—উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছেই।

২৩ সেনার মৃত্যু: আফগান বাহিনীর বিশাল ক্ষতি

পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী, নিহত ২৩ আফগান সেনা ছিলেন—

  • সীমান্ত রক্ষী ইউনিটের সদস্য
  • তালেবান সরকারের অধীনস্থ ‘বর্ডার ফোর্স’
  • স্পিন বোলদাকের বিশেষ মোতায়েন বাহিনী

তাদের মৃত্যুর ঘটনায় আফগান তালেবান সরকার নিঃসন্দেহে চাপে পড়বে।
সীমান্তে যে তাদের শক্তি কমছে—পাকিস্তান তা প্রকাশ্যে প্রমাণ করলো।

সীমান্ত রাজনীতির ভবিষ্যৎ: কী হতে পারে সামনে?

১. বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনা কম

দুই দেশই বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তাই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ানোর মতো সক্ষমতা নেই।

২. নিয়মিত ছোটখাটো সংঘর্ষ বাড়তে পারে

সীমান্তে চেকপোস্ট, পাহারার নিয়ম, অনুপ্রবেশ—এসব নিয়ে ছোট যুদ্ধ চলতেই পারে।

৩. বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়তে পারে

চামান সীমান্ত বন্ধ হলে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য ও ওষুধ সংকট আরও বাড়বে।

৪. আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রয়োজন

কেউ কেউ বলছেন, জাতিসংঘ বা ওআইসি’র মধ্যস্থতা ছাড়া এই সীমান্ত সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব।

চামান সীমান্তে পাকিস্তানের হামলায় আফগান তালেবান সেনাদের ২৩ জনের মৃত্যু দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। দুই দেশের সম্পর্ক এর আগেও উত্তপ্ত ছিল, তবে সাম্প্রতিক ঘটনা প্রমাণ করে—সীমান্তে যে কোনো সময় বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

এই সংঘর্ষ শুধু সামরিক নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে, কিন্তু সমাধান কোথায়—তা এখনো অজানা।

MAH – 14175 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button