বিশ্ব

নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের ক্ষমতা নেই: মেয়রকে গভর্নরের স্পষ্ট বার্তা

Advertisement

নিউইয়র্ক সিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আলোচিত একটি রাজনৈতিক বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে যখন নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর ক্যাথি হোচুল সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, নবনির্বাচিত নিউইয়র্ক সিটির মেয়র জোহরান মামদানির কোনোভাবেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা নেই।
স্থানীয় সময় ৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর হোচুলের এই মন্তব্য ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র–নির্বাচিত জোহরান মামদানি ঘোষণা করেছিলেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তিনি নিউইয়র্ক সফরের সময় সেটি কার্যকর করার চেষ্টা করবেন। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।

গভর্নর হোচুল বলেন—
“নিউইয়র্ক সিটির মেয়রের এমন কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা ফেডারেল আইনের আওতায় বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেওয়া স্থানীয় সরকারের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।”

মামদানির অবস্থান: ‘আইসিসির পরোয়ানা বৈধ, তাই আমরা ব্যবস্থা নেব’

মেয়র–নির্বাচিত জোহরান মামদানি, যিনি নিউইয়র্কের কুইন্স থেকে নির্বাচিত এবং প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইল সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ সংঘাত, হাজারো মানুষের প্রাণহানি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার মতো তিনিও ইসরাইল সরকার ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

তিনি ঘোষণা করেছেন—
“আইসিসি যখন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তখন একটি সভ্য সমাজে সেই পরোয়ানা কার্যকর হওয়া উচিত। কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নেতার নিউইয়র্কে অবাধে ঘোরাঘুরি করার অধিকার নেই।”

তবে এই বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বহু আইন বিশেষজ্ঞ।

আইসিসি–র পরোয়ানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ২০২৫ সালের শুরুর দিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তশেষে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

তবে এর মধ্যে রয়েছে জটিল বাস্তবতা।
যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয় এবং দেশটির আইন অনুযায়ী ICC–র সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা ফেডারেল আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ। ফলে নিউইয়র্ক রাজ্যের প্রশাসন, সিটি সরকার বা কোনো স্থানীয় সংস্থা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে সহযোগিতা করতে পারে না।

মার্কিন আইনে আরও বলা হয়েছে—

  • বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান,
  • কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল,
  • জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশ নিতে আসা কর্মকর্তাদের

আটক, কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি বা জোরপূর্বক গ্রেফতার করা আইনত অপরাধ।
জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউইয়র্কেই অবস্থিত হওয়ায় এখানে রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল সরকারের অধীন।

আইন বিশেষজ্ঞরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন—
“মেয়র হিসেবে মামদানির এমন কোনো তদন্ত পরিচালনা বা গ্রেফতারি প্রক্রিয়া শুরু করার বিধান নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে ফেডারেল সরকারের আওতার বিষয়।”

গভর্নর হোচুল: ‘আমি এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নই’

সংবাদ সম্মেলনে যখন একজন সাংবাদিক গভর্নর হোচুলকে প্রশ্ন করেন—
“মেয়র–নির্বাচিত মামদানি বলেছেন, নেতানিয়াহু নিউইয়র্ক এলে তিনি তাকে গ্রেফতার করবেন। এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কী?”—

তখন গভর্নর জবাব দেন—
“আমি এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নই। নিউইয়র্ক সিটির মেয়রের এমন ক্ষমতা নেই এবং এটি স্থানীয় সরকারের এখতিয়ারের বাইরে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন মন্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন।”

তার এই বক্তব্যের পরই যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনৈতিক মহলে মামদানির অবস্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়া: ‘আমি নিউইয়র্ক সফর করব’

নেতানিয়াহু বুধবার জেরুজালেমে সাংবাদিকদের বলেন—
“আমি প্রতি বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যাই। এবারও যাব।”

তিনি আরও দাবি করেন যে—
“ইসরাইলের ওপর যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”

নেতানিয়াহু সাধারণত প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে (UNGA) ভাষণ দিতে নিউইয়র্ক আসেন এবং সেখানে ইহুদি সংগঠন, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
২০২৫ সালেও তার আগের মতোই সফর পরিকল্পনা রয়েছে।

মামদানির রাজনৈতিক যাত্রা এবং ইসরাইল ইস্যুতে কঠোর অবস্থান

উগান্ডা–জন্ম, ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের প্রগতিশীল ডেমোক্রেটদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় নাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, অভিবাসী অধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রশ্নে সোচ্চার।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনি কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত।
নিউইয়র্কের প্রভাবশালী ইহুদি সম্প্রদায়ের অনেক সদস্য তাই তার মেয়র হিসেবে নির্বাচনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ইহুদি জনসংখ্যা বসবাস করে, এবং ইসরাইলকে সমর্থন করাই তাদের দীর্ঘদিনের অবস্থান।

মামদানি নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকে বারবার বলেছেন—
“মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আমার দায়িত্ব। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক সফর করলে আমি তাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জবাবদিহির মুখোমুখি করব।”

অন্যদিকে সমালোচকরা বলছেন—
“স্থানীয় সরকারের কাজ হচ্ছে শহরের অবকাঠামো, নিরাপত্তা, কর, বাসস্থান—জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কূটনীতি নয়।”

যুক্তরাষ্ট্র–ইসরাইল সম্পর্ক এবং নিউইয়র্কের বিশেষ অবস্থান

ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র।
ওয়াশিংটন প্রতি বছর ইসরাইলকে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়। ফলে নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের মতো বিষয় যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে, যা কোনো শহর মেয়রের দ্বারা সম্ভব নয়।

নিউইয়র্ক সিটির আরও একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে—
জাতিসংঘের সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এখানে রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা ও চলাফেরা নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার।

জাতিসংঘ সদর দপ্তর চুক্তি অনুযায়ী—
রাষ্ট্রপ্রধানরা অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে আসলে শত্রু দেশ বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা তাদের আটকের ঝুঁকি থাকবে না।
এটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক রীতির একটি অপরিবর্তনীয় অংশ।

সুতরাং, নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে মামদানি এই চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবেন না।

আইন বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: ‘মামদানির দাবি রাজনৈতিক প্রতীকী পদক্ষেপ’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—
মামদানির বক্তব্য মূলত মানবাধিকার প্রশ্নে একটি “প্রতীকী প্রতিবাদ”। এটি বাস্তব কোনো আইনি প্রক্রিয়া নয়।
যেমন:

  • আইসিসির যুক্তরাষ্ট্রে কোনো এখতিয়ার নেই
  • নিউইয়র্ক পুলিশ (NYPD) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পরোয়ানা কার্যকর করতে কর্তৃত্ববিহীন
  • ফেডারেল আইন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে স্পর্শ করাও ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করে

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞ জেমস লরেন্স বলেন—
“মেয়র মামদানির বক্তব্য নৈতিক অবস্থান হতে পারে, কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব। তিনি রাজনৈতিক চাপের মুখে এমন বক্তব্য দিয়েছেন।”

ইহুদি সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বৃদ্ধি

নিউইয়র্কের ইহুদি সম্প্রদায়ের অনেক নেতা উদ্বিগ্ন হয়েছেন মামদানির কঠোর ইসরাইলবিরোধী অবস্থান দেখে।
তারা বলছেন—
“নিউইয়র্কের মতো বৈচিত্র্যময় শহরে একজন মেয়রের উচিত সবার প্রতিনিধিত্ব করা। আন্তর্জাতিক কূটনীতি নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য নিউইয়র্কের সামাজিক পরিবেশকে উত্তেজিত করতে পারে।”

অন্যদিকে, প্রগতিশীল সংগঠনগুলো মামদানির অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে বলেছে—
“গাজার নির্যাতিত মানুষদের পক্ষ নেওয়া কোনোভাবেই অবৈধ নয়।”

মামদানির দায়িত্ব গ্রহণ এবং সামনে কী হতে পারে

মেয়র–নির্বাচিত জোহরান মামদানি আগামী ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। তিনি শপথ নেওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছেন।

নেতানিয়াহু যদি সত্যিই ২০২৬ সালের শুরুতে জাতিসংঘের কোনো অধিবেশন বা যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসেন, তাহলে নিউইয়র্কে সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক উত্তেজনা, এবং জনমত নতুনভাবে পরীক্ষা দিতে পারে।

অনেকে মনে করছেন—
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর মামদানি বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার রাজনৈতিক অবস্থান কিছুটা নরম করতে পারেন।
আবার অন্যরা আশা করছেন—
তিনি তার প্রতিশ্রুতির জায়গায় অটল থাকবেন এবং মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন আলোচনা তৈরি করবেন।

গভর্নর ক্যাথি হোচুলের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে—
নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির কোনোভাবেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করার আইনগত ক্ষমতা নেই।
আইন, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং ফেডারেল নীতিতে এটি সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।

তবুও মামদানির বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে—
কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের প্রভাবকে বাস্তবসম্মতভাবে সামনে এনেছে।

আগামী মাসগুলোতে নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবই নজর রাখবে—
মেয়র–মামদানির অবস্থান কীভাবে বাস্তবে রূপ নেবে, এবং নিউইয়র্কের রাজনৈতিক পরিবেশ কোন পথে এগোবে।

MAH – 14174 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button