বিশ্ব

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে সংঘাত তীব্র: নিহত ৪ বেসামরিক

Advertisement

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে শুক্রবার রাতে চার ঘণ্টা ধরে তীব্র গোলাবিনিময় হয়েছে। উভয় পক্ষই এই সংঘাতের কথা নিশ্চিত করেছে, তবে এই ঘটনার জন্য একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। এই সামরিক সংঘর্ষের ফলে সীমান্তের আফগান অংশে চারজন বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কান্দাহার তথ্য বিভাগের প্রধান আলি মোহাম্মদ হাকমাল। অক্টোবরের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এটি দুই দেশের মধ্যে নতুন ও গুরুতর উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

সীমান্ত সংঘাতের বিবরণ: ভারী অস্ত্রের ব্যবহার

শুক্রবার রাতে আনুমানিক রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে এই সীমান্ত সংঘাত শুরু হয় এবং প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলে। কান্দাহারের তথ্য বিভাগের প্রধান আলি মোহাম্মদ হাকমাল জানান, পাকিস্তানের বাহিনী হালকা ও ভারী কামান দিয়ে আক্রমণ করেছে। মর্টারের আঘাতে বেসামরিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র মোশাররফ জাইদি তালেবানের বিরুদ্ধে উস্কানিবিহীন গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী এর জবাবে তাৎক্ষণিক, যথাযথ এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। উভয়পক্ষই সংঘাতের জন্য একে অপরকে দায়ী করায়, প্রকৃত সত্য যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সংঘর্ষের সময় সীমান্তে আফগানিস্তান অংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুলসংখ্যক আফগান হেঁটে ও যানবাহনে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে যায়

হতাহতের ঘটনা ও বেসামরিকদের ক্ষয়ক্ষতি

আফগানিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলের স্পিন বোল্ডাক জেলার গভর্নর আবদুল করিম জাহাদ এএফপিকে জানিয়েছেন, এই ঘটনায় চারজন বেসামরিকের প্রাণ গেছে এবং আরও চারজন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানের সীমান্ত শহর চামানের স্থানীয় হাসপাতাল জানিয়েছে, সংঘর্ষে সামান্য আঘাত পাওয়া তিনজনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বেসামরিক বাড়িঘরে মর্টারের গোলা পড়ার ঘটনা আফগান কর্তৃপক্ষের দাবিকে সমর্থন করে। এই ধরনের সীমান্ত সংঘর্ষে বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানি দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কে আরও মানবিক সংকট তৈরি করবে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া পোস্টে বলেন, “দুঃখজনকভাবে আজ রাতে পাকিস্তান আফগানিস্তানের কান্দাহারের স্পিন বোল্ডাক জেলায় হামলা চালায়। ফলে আফগান বাহিনী পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয়।”

যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন ও আলোচনায় প্রভাব

দুই মাস আগে কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছিল। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও, শুক্রবার রাতের এই সংঘাত সেই চুক্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এটি ২০২১ সালে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর উভয়ের মধ্যে হওয়া সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের পর দ্বিতীয় গুরুতর সংঘাত।

গত সপ্তাহেও দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা সৌদি আরবে শান্তি আলোচনার জন্য মিলিত হন। যদিও সেই আলোচনায় কোনো স্থায়ী চুক্তি হয়নি, তবে তারা যুদ্ধবিরতি চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছিলেন। নতুন এই সংঘর্ষ সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে এবং শান্তি আলোচনাকে আরও কঠিন করে দেবে।

নিরাপত্তা ইস্যুতে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যেকার বিরোধের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো নিরাপত্তা ইস্যু

পাকিস্তানের অভিযোগ: পাকিস্তান অভিযোগ করে আসছে যে, আফগানিস্তান টিটিপি (পাকিস্তানি তালেবান)-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর পাকিস্তানের তালেবান (টিটিপি) পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর কমপক্ষে ৬০০টি হামলা চালিয়েছে।

তালেবানের অস্বীকার: তবে তালেবান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং বলছে, তাদের ভূখণ্ড পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গিদের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না।

এই আস্থার অভাব এবং অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কারণেই দুই দেশের সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, যা বাণিজ্য ও জনগণের যাতায়াতকে ব্যাহত করছে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমন অভিযান

সীমান্ত সংঘাতের এই খবরের পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনেও কঠোর অভিযান চালাচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) শনিবার জানিয়েছে, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের টাঙ্ক এবং লাক্কি মারওয়াত জেলায় পৃথক গোয়েন্দা অভিযানে ৯ সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

সামরিক গণমাধ্যম শাখা জানিয়েছে, নিহত ৯ জনই টিটিপি’র সদস্য ছিল। আইএসপিআর জানিয়েছে, দেশ থেকে বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী নির্মূলের জন্য এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি এই সফল অভিযানের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশংসা করেছেন।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে চার ঘণ্টা ধরে চলা তীব্র গোলাবিনিময় এই অঞ্চলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার গভীর শঙ্কা তৈরি করেছে। চারজন বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনা মানবিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সংঘাত কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে লঙ্ঘন করেছে। দুই দেশের মধ্যে আস্থার অভাব এবং সীমান্ত সন্ত্রাসের দায় নিয়ে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের সংঘাতের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা এবং আফগানিস্তানের মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলবে।

এম আর এম – ২৫১৯, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button